‘এখনও কলকাতা আমার ওই ইডেনের ইনিংসটা মনে রেখেছে’
প্রকাশিত : ১০:৩০ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার
একটা সময় ভারতীয় বোলিংয়ের ত্রাস ছিলেন তিনি। শারজা থেকে কলকাতা, একার হাতে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে। তিনি— সেলিম মালিক, এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের আগে করাচি থেকে ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আনন্দবাজারকে। যে সাক্ষাৎকারে বারবার ধরা পড়ছিল অতীতের সেই দাপুটে লোকটা। যেখানে উঠে এল স্মৃতিচারণা থেকে বর্তমান ক্রিকেট, সব কিছু। আর সব শেষে থাকল নতুন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রতি এক করুণ আবেদন।
প্রশ্ন: ক্রিকেট আবার মরুশহরে ফিরছে। শারজায় না হোক দুবাইয়ে। পুরনো কথা মনে পড়ে?
মালিক: অবশ্যই। সে সব ভোলা যায়! শারজায় পৌঁছনো মাত্র ভক্তরা প্রায় ঘেরাও করে ফেলত। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে দু’দেশে উত্তেজনা তো থাকতই, কিন্তু শারজার মানুষ বেশি করে মেতে উঠত। ওদের একটাই চাহিদা ছিল। যে ভাবে হোক, ভারতকে হারাতেই হবে।
প্রশ্ন: তার মানে তো ভারত-পাক ম্যাচ নিয়ে ওই সময় উন্মাদনা চরমে থাকত?
মালিক: সে আর বলতে। আসলে কী জানেন, আমরা তো ম্যাচ খেলে যে যার নিজের দেশে ফিরে যেতাম। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের মধ্যে রেষারেষিটা চলতেই থাকত। যারাই জিতত, ছড়ি ঘোরাত। ওই যে কথায় আছে না, ঝড় থেমে গেলেও তার রেশ থেকে যায়। ব্যাপারটা ও রকম আর কী (হাসতে হাসতে)।
প্রশ্ন: আপনি তো ভারতের বিরুদ্ধে অনেক ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন। কোন ইনিংসটাকে সেরা বলবেন?
মালিক: শারজার কথা বলছেন, না সব মিলিয়ে?
প্রশ্ন: সব মিলিয়ে।
মালিক: সে তো আমি ভারতের মাটিতেই খেলেছি। আপনাদের কলকাতায়। ইডেন গার্ডেন্সে। হারা ম্যাচ জিতিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: কলকাতা এখনও ভুলতে পারেনি সেই ইনিংস। (ভারত-পাকিস্তান, ১৯৮৭ ওয়ান ডে। ভারত ৪০ ওভারে ২৩৮-৬, পাকিস্তান ৩৯.৩ ওভারে ২৪১-৮। মালিক করেন ৩৬ বলে অপরাজিত ৭২)।
মালিক: ম্যাচটা আমরা প্রায় হেরেই গিয়েছিলাম। আমি নেমেছিলাম সাত নম্বরে। আস্কিং রেট আকাশছোঁয়া হয়ে গিয়েছিল। ওখান থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করি। কেউ ভাবেনি পাকিস্তান ওই ম্যাচ জিতবে। আমার এবং দলের কাছে ওই জয়টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার তো মনে হয়, ভারতেও এখনও লোকে আমার ওই ইডেনের ইনিংসটা মনে রেখেছে। এই যেমন আপনি জিজ্ঞেস করলেন।
প্রশ্ন: তার পর থেকে দেখা গিয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত প্রচুর ম্যাচ হেরেছিল। কারণটা কী? মানসিক চাপ?
মালিক: ভারতকে দেখে মনে হত, সব সময় যেন চাপে আছে। ভয়ে, ভয়ে ক্রিকেটটা খেলছে। আসলে কী জানেন, ভারতে একটা-আধটা ম্যাচ দেখেই ক্রিকেটারদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যেত। বিশেষ করে পাকিস্তান ম্যাচে খারাপ খেললে তো কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে বাদ দেওয়ার দাবি উঠে যেত। তাই ওরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকত। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা অন্য রকম ছিল।
প্রশ্ন: কী রকম?
মালিক: আমরা কখনও ভয় পেতাম না। আমাদের ক্যাপ্টেন ছিল ইমরান খান। ইমরান আমাদের বলত, জেতার জন্য নামবে। কাউকে বা কোনও কিছুকে ভয় পাবে না। খোলা মনে খেলবে। খারাপ খেললেও বাদ পড়বে না। কিন্তু একশো ভাগ উজাড় করে দেবে। ছেলেরাও তাই করত। আর সেটাই ছিল আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।
প্রশ্ন: এখনও কি এই ব্যাপারটা আছে বলে মনে হয়?
মালিক: ভারতীয় দল অনেক বদলে গিয়েছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির আমল থেকে। এখন আর বিশেষ ভয় পায় না। ভারতীয় দলের মানসিকতা বদলের জন্য ধোনিকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। তার পরে বিরাট কোহালি এসে দলটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: আজ, বুধবার এশিয়া কাপে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান। কাকে এগিয়ে রাখবেন?
মালিক: এশিয়ার মাটিতে ভারত খুবই শক্তিশালী দল। ইংল্যান্ডে ভাল খেলতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু এশিয়ার লো বাউন্স পিচ, যেখানে বল সে রকম সুইং হয় না, সেখানে ভাল খেলবে। যারা ইংল্যান্ডে ভাল খেলতে পারেনি, তারাও খেলে দেবে। তা ছাড়া রোহিত আছে। আর আপনাদের ওপেনার কে এল রাহুল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টে ভাল খেলে এসেছে। ছেলেটা ওয়ান ডে-তেও ভাল খেলবে।
প্রশ্ন: তার মানে কি বলতে চান, ভারতই ফেভারিট?
মালিক: না, সে রকম বলছি না। আসলে কী জানেন, এই ম্যাচে যারা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলবে, তারাই জিতবে। জো ডর গয়া, ও মর গয়া। ভয় পেয়েছো, কী তুমি মরেছো। এটাই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটের চিরকালীন রেওয়াজ।
প্রশ্ন: বিরাট কোহালির না-থাকাটা কতটা ভোগাবে ভারতকে?
মালিক: বিরাট হল এমন একজন ব্যাটসম্যান, যে চাপটা শুষে নিতে পারে। অন্যদের ওপর চাপ আসতে দেয় না। এ বার দেখতে হবে, আপনাদের এই ভারতীয় দলে কে সেটা করতে পারে। চাপ সামলাতে না পারলে কিন্তু গেলেন। শেষ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটাই দেখুন না (গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল)। পাকিস্তানের ছেলেরা সম্পূর্ণ চাপমুক্ত হয়ে খেলে গেল। তা-ই ম্যাচটাও জিতল। ওই যে বলেছিলাম, চাপে পড়লে চলবে না, ভয় পেলে চলবে না। ভারত-পাকিস্তান এমন একটা লড়াই, যা শুধু প্রতিভা দিয়ে জেতা যায় না। কলজে দিয়ে জিততে হয়।
প্রশ্ন: আপনি ম্যাচটা দেখবেন তো?
মালিক: হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন দেখব না। ম্যাচ তো টিভি-তে দেখাবে। টেলিভিশন জিন্দাবাদ।
প্রশ্ন: শারজার কথায় ফিরি। সেই ১৯৮৬ সালের অস্ট্রেলেশিয়া কাপ ফাইনাল। শেষ বলে জাভেদ মিয়াঁদাদের ছয়। তার পরে যেন ভারত আরও গুটিয়ে গিয়েছিল শারজায়।
মালিক: সত্যি কথা বলব? ওই ম্যাচটায় আমাদের ভাগ্যটা খুব ভাল ছিল আর ভারতের খারাপ। না হলে কেউ ওই ম্যাচ হারে! শর্মা (চেতন) একটা ফুলটস করে বসল, আর জাভেদ ভাই ছয় মেরে দিল। তবে এটা ঠিক, ভারত তার পর থেকে চাপে পড়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: শারজায় আপনার সেরা ইনিংস কোনটা?
মালিক: (একটু ভেবে) কোনটা বলি বলুন তো? ভারতের বিরুদ্ধে আমি বরাবরই ভাল খেলতাম। রেকর্ড বই দেখে নেবেন। ম্যান অব দ্য সিরিজও হয়েছি। আলাদা করে একটা ইনিংস বাছা বেশ কঠিন।
প্রশ্ন: আচ্ছা, এটা বলুন, কোন ভারতীয় বোলারকে খেলতে আপনার সমস্যা হত?
মালিক: অবশ্যই কপিল পাজি। দারুণ বোলার ছিল। আর আপনাদের এক জন বাঁ হাতি স্পিনার ছিল, সর্দার, কী যেন নাম...
প্রশ্ন: মণিন্দর সিংহ?
মালিক: হ্যাঁ, হ্যাঁ, মণিন্দর সিংহ। খুব ভাল বোলার ছিল। আমাদের বিরুদ্ধে ওর পারফরম্যান্স বেশ ভাল।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। আপনি কি এখন কোনও ভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত? (ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগে ক্রিকেট থেকে সেলিম মালিককে নির্বাসিত করেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড)।
মালিক: কুড়ি বছর ধরে আমার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনও যোগাযোগ নেই। পাকিস্তান বোর্ড আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তবে ইমরান খান এ বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। আশা করব, পরিস্থিতিটা বদলাবে। এই তো ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্যদের ইমরান ডেকেছিল। আমিও ওই দলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছি। আশা করি, ইমরান সেটা ভুলে যাবে না। আমি নিশ্চয়ই আরও একটা সুযোগ পাব ক্রিকেটে ফিরে আসার।
(সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষে এসে ডাকাবুকো লোকটার গলায় শুনলাম একটা আকুল আর্তি। যেন তাঁর অধিনায়কের দিকে তাকিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব সেলিম মালিক বলছেন, আমাকে আর একটা সুযোগ দাও, ইমরান!)
*আনন্দবাজার অবলম্বনে
//এস এইচ এস//