ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

তিন দশক ধরে ফ্রি রোগী দেখেন যিনি

প্রকাশিত : ০৫:১৯ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

কিশোরগঞ্জে গরীব-দুঃখী মানুষের ভরসার জায়গা ডা. ইসরাঈল হোসেন। যিনি সানন্দে বিনা টাকায় রোগী দেখে মনে তৃপ্তি পান। তিনি রোজ যে কয়জন রোগী দেখেন তাঁদের বেশিরভাগের কাছ থেকেই টাকা নেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা ইসরাঈল সারাদিনে যতজন রোগী দেখেন, তার মধ্যে অধিকাংশই দেখেন বিনামূল্যে। তার ঘনিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে অন্তত ৩০০ জন রোগীই বিনামূল্যে দেখে থাকেন তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর  এই অনুশীলন।

২০ বছর ধরে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে আসছেন শহরের গাইটাল শিক্ষকপল্লী এলাকার অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম। তিনি একুশে টিভি অনলাইনকে  জানান, একজন ডাক্তারের যেসব গুণাবলী থাকা দরকার, অনেকের মধ্যেই তা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ডা. ইসরাঈল হোসেন অনন্য। তিনি শুধু ডাক্তার হিসাবেই নয়, ব্যক্তি হিসাবেও অসাধারণ।

জেলা শহরের খরমপট্টি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সাত্তার বকুল একুশে টিভি অনলাইনকে  বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাকে আমি স্যালুট জানাই। ওনি শুধু আমাকে বিনামূল্যে চিকিৎসাই দেন না, তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধও পেয়ে থাকি বিনা টাকায়।

জানা গেছে, গ্রামের গরীব অসহায় মানুষের টাকার অভাবে চিকিৎসা না পাওয়া ও তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে বড় হয়েছেন ডা. ইসরাঈল। বিষয়টা তাঁকে খুবই পীড়া দিতো। এজন্যই মূলত তাঁর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন জাগে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে হয়ে উঠেন দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের ভরসাস্থল। কিশোরগঞ্জের এ চিকিৎসক গত তিন যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেবা দিয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার পূমদী ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন ইসরাঈল হোসেন । তার বাবার নাম সাবেদ আলী। যে সময়টাতে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই প্রথম শ্রেণিতেই বাবাকে হারিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে হয় তাকে । তবে তার মমতাময়ী মায়ের প্রেরণায় নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন তিনি।

ছোট এক ভাই ও এক বোনকে নিয়ে একরকম সংগ্রামের মধ্যেই বেড়ে ওঠা ইসরাইলের স্কুল জীবন শুরু করে আতিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে পূমদী ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি।

হোসেনপুর মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। হোসেনপুর-গফরগাঁও পরীক্ষা কেন্দ্রে তিনি একমাত্র ছাত্র যিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর থেকে এলাকায় তিনি হয়ে উঠেন অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য প্রেরণা। ছোটবেলা থেকেই আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তখনও তাঁর কল্পনায় আসেনি মেডিকেলে পড়াশোনা করে ডাক্তার হবেন।

এইচএসসিতে চমকপ্রদ রেজাল্টের পর শিক্ষকদের পরামর্শেই সিদ্ধান্ত নেন মেডিকেলে পড়ার। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অদম্য মেধা ও চেষ্টার ফলে ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেয়েই নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন তিনি। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

এমবিবিএস পাসের পরপরই সহকারী সার্জন ইনসার্ভিস ট্রেইনী হিসাবে ডাক্তারি পেশা শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার (এডহক) হিসাবে যোগ দেন। দ্রুততম সময়ে দশম বিসিএস পাশ করে স্বাস্থ্য ক্যাডারেও অন্তর্ভূক্ত হন তিনি ।

১৯৯৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করেন।  ২০০৬ সাল থেকে দুই বছর কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আরএমও হিসাবে কাজ করেন। এর আগে নেত্রকোনার মদন হাসপাতালে দীর্ঘ 10 বছর ও শরীয়তপুর জেলায় দুবছর কাজ করে আবার কিশোরগঞ্জ প্রত্যাবর্তন করে ইটনা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন।  ৩৪ বছর সরকারি ডাক্তার হিসাবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে ২০১৬ সালে তিনি অবসরে যান।

অবসর! সে তো অবসর নয়। সরকারি চাকরি শেষ করে পুনরায় নিজেকে নতুন উদ্যমে আর্তমানবতার সেবায় চিকিৎসায় নিয়োজিত হন ডা. ইসরাঈল। বিনামূল্য আর স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা পেয়ে বিভিন্ন স্থান থেকেই চিকিৎসাবঞ্চিত অসহায় রোগীরা আসতে থাকে তার কাছে।  তবে ব্যস্ততম জীবনের যতটুকু সময়ই অবসর পান বই পড়া আর গান শুনেই সে সময় কাটান তিনি।

বিনামূল্যে কেন চিকিৎসা দেন এমনটি জানতে চাইলে ডা. ইসরাঈল হোসেন একুশে টিভি অনলাইনকে  বলেন, আমি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি আর নিজের আত্মতৃপ্তি থেকে গরীব মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে যাচ্ছি। তারা যখন এসে অসহায়ত্বের কথা বলে, তখন  নিজের অজান্তেই কষ্ট অনুভব করি।

তিনি বলেন, নানা সময়ে ডাক্তারদের ব্যাপারে নানা ধরনের কথা শোনা যায়। সব ডাক্তারই যে ভাল কাজ করে এটা বলা যাবে না, তবে ভুল বোঝাবুঝির সংখ্যাটাই বেশি।

ডা. ইসরাঈলের চিকিৎসা সেবা নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের হয়বতনগর এলাকার বাসিন্দা ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মাহবুবুর রহমান একুশে টিভি অনলাইনকে  বলেন, এরকম কর্মনিষ্ট ও মানবসেবী ডাক্তার আমাদের সমাজে খুবই দরকার। সবসময় সব রোগীর সঙ্গেই সমান সদাচরন তার।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম একুশে টিভি অনলাইনকে  বলেন, ব্যক্তি হিসাবে ডাক্তার ইসরাঈল চমৎকার একজন মানুষ। শুনেছি প্রচুর পরিমাণ গ্রাম্য গরীব-অসহায় রোগী তার কাছে আসে এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা নেয়। অন্যান্য ডাক্তাররা যেখানে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে তিনি গরিব অসহায়দের নিরবে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন অফিসার ডা. হাবিবুর রহমান জানান, ব্যক্তিগতভাবে ওনি একজন সৎ মানুষ। প্রত্যেক ডাক্তারই ফ্রি কিছু কিছু রোগী দেখেন। তবে ওনার ব্যাপারে আলাদাভাবে জেনে ভাল লাগলো । ওনার মত প্রত্যেক ডাক্তারেরই সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করা উচিত ।

/ এআর /