ওষুধ কেন খাবেন?
প্রকাশিত : ১০:৩৯ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১১:২৮ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার
ফার্মাসিস্টরা ওষুধ বিষয়ক জ্ঞান ও পরামর্শ প্রদানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। এটি শুধু রোগীদের জন্যই নয়, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত অন্য পেশাজীবীদের জন্যও। কারণ শিক্ষাজীবনে ফার্মাসিস্টরা ওষুধের কার্যকর ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে যেসব বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করে তার মধ্যে রয়েছে :ওষুধের উৎস চিহ্নিতকরণ বাছাই ও নির্বাচন, এগুলোর নিদানিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিবেচনা, শরীরের ওজন উচ্চতা ও অবস্থা অনুযায়ী রোগীর জন্য ওষুধের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ, ওষুধকে প্রয়োজনীয় স্থায়িত্ব প্রদান, চিকিৎসার সুবিধার্থে প্রয়োজনে ওষুধের মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ তৈরির জন্য মূল উপাদানের সঙ্গে অনুষঙ্গী উপাদান ব্যবহার, সর্বোত্তম উৎপাদন কৌশল অনুসরণ, সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ ও বিশ্নেষণ, প্রস্তুতি ও উৎপাদনের প্রতিটি ধাপ প্রমিতকরণ, রোগীকে কীভাবে ওষুধটি নিরাপদে ব্যবহার করতে হবে তার পরামর্শ প্রদান, সর্বোত্তম কার্যকারিতা পাওয়ার লক্ষ্যে ব্যবহার পদ্ধতি ও পথ্য নির্বাচন, ওষুধের অনৈতিক বিপণন ও বিক্রি রহিতকরণ, দেশব্যাপী বিতরণ ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় সংরক্ষণ, নতুন ওষুধ আবিস্কারের গবেষণা ইত্যাদি।
এর ফলে ফার্মাসিস্টরা উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্স-পুষ্টিবিদ-প্যারামেডিকদের নিয়ে গঠিত যে টিম তার গর্বিত বিশেষজ্ঞ সদস্য।
বাংলাদেশের ফার্মাসিস্টরা এতকাল ধরে ওষুধ শিল্প কারখানায় তাদের অবদান রেখেছেন। ফলে আমাদের ওষুধ শিল্প খাত আজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এই খাতে ওষুধ উৎপাদনের জন্য যে বিপুল সংখ্যক দক্ষ ফার্মাসিস্টরা কাজ করছেন, তারা সবাই এ দেশেরই ফার্মাসিস্ট। তাদের মেধা ও দক্ষতার কারণে এই খাতে কোনো বিদেশি ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন হয়নি।
পৃথিবীতে আর কোনো দেশ ওষুধ খাতে যে সাফল্যটি অর্জন করতে পারেনি, আমরা সেটি পেরেছি। আমরা এখন দেশের বার্ষিক চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ নিজের দেশে তৈরি করছি। কোনো উন্নত দেশও এটি পারেনি। বাংলাদেশকে এখন তার বার্ষিক চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয়। ভিয়েতনাম বার্ষিক চাহিদার মাত্র ৬০ শতাংশ তার দেশে উৎপাদন করতে পারে। ফিলিপাইন করে ৬৫ শতাংশ, উন্নত দেশ হওয়ার পথে প্রায় চলে গেছে যে মালয়েশিয়া তারা করে ৭০ শতাংশ আর উন্নত দেশ বলে পরিচিত সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে তা ৮০ শতাংশ।
আমরা এখন উচ্চপ্রযুক্তির সাসটেইন্ড রিলিজ ফর্মুলেশন, আই ড্রপস, মিটারড ডোজ ইনহেলার, এরোসল, ইনজেকশন, লার্জ ভল্যুম প্যারেনটেরালস, প্রি-ফিলড সিরিঞ্জ, লাইওফিলাইজড ভায়াল ইত্যাদিসহ সব ধরনের ডোজেস ফর্মের ওষুধ উৎপাদন করতে পারি।
বাংলাদেশে এখন বছরে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়। এই বিপুল পরিমাণ ওষুধ যদি দেশে তৈরি করা না যেত, তাহলে এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। শুধু তাই নয়, গত বছর বাংলাদেশ থেকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত মিলিয়ে মোট ১৫১টি দেশে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৮২২ কোটি টাকার ওষুধ রফতানি হয়েছে। ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে গত বছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশ। দেশের অর্থনীতির উন্নতির ক্রমধারায় ওষুধের মান সঠিক থাকলে এবং চাহিদামতো সঠিকভাবে জোগান দিতে পারলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ওষুধের বিক্রি সেই সঙ্গে রফতানি আয় উভয়ই ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ওষুধের কোম্পানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিকোয়ালিফিকেশনের জন্য আবেদন করেছে। এর মাধ্যমে আমাদের দেশ বিশ্বব্যাপী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সরবরাহকারী হিসেবে বিপুল পরিমাণ ওষুধ রফতানি করতে পারবে। বাংলাদেশের আটটি ওষুধ কোম্পানি ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ ইত্যাদি গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসের সনদ লাভ করেছে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ সনদ লাভ করেছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে কোম্পানির এই সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা যায়। যদি তাই হয় এবং যদি ওষুধ রফতানির ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যায়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত `রূপকল্প ২০২১`-এর বছরে আমাদের ওষুধ রফতানির পরিমাণ এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৮৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বাংলাদেশের দুটি কোম্পানি ওষুধ রফতানির অনুমতি পেলেও এখনও মাত্র একটি কোম্পানি একটি ওষুধ দিয়ে রফতানি শুরু করে এখন ১১টি ওষুধ রফতানি করছে। আগামী দুই বছরে আরও ৫টি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানির জন্য এফডিএর অনুমোদন পাবে। পৃথিবীতে গত বছর (২০১৭) বিক্রি হয়েছে ১.১৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওষুধ। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয়েছে ৪৬১.৭ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ, যার মধ্যে জেনেরিক ওষুধ বিক্রি হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলারের। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের এই জেনেরিক মার্কেটটির দিকে তাকিয়ে আছি। এটিই আমাদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জেনেরিক মার্কেট, যা আগামী ২০২১ সালে বেড়ে হবে ৮০ বিলিয়ন ডলার। আমরা বিপুল পরিমাণ সঠিক মানের ওষুধ নিয়ে এই বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে চাই।
আমাদের দেশে ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহূত অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ওষুধ খাত ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কাঁচামালে এই বিদেশনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার বাউসিয়া ইউনিয়নের তেতৈতলা গ্রামে এর জন্য ২০০ একর জমি চূড়ান্ত করে। ২০১৬ সালে এর জমি উন্নয়নের কাজ সমাপ্ত হয়। এই বিশাল এলাকায় ৪২টি কোম্পানিকে প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে ট্যানারি শিল্পের মতো অবস্থা যাতে না হয় সে জন্য এখন এর বাধ্যতামূলক কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। দুয়েক মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রথম এই `একটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট পার্ক (এপিআই পার্ক)` উদ্বোধন করবেন। আশা করা যায়, এরপর এখান থেকে আন্তর্জাতিক মানের ঔষধি কাঁচামাল উৎপাদন শুরু হলে বিদেশনির্ভরতা অনেক কমে আসবে, ফিনিশড ড্রাগ ও এপিআই উভয়ের উৎপাদন ও রফতানি আরও বাড়বে।
ওষুধের মান সরকারিভাবে পরীক্ষার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রমে দুটি ওষুধ পরীক্ষাগার রয়েছে, যা আগে উপযুক্তভাবে কার্যকর না থাকলেও বর্তমান সরকারের উদ্যোগে প্রচুর সূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত করে এগুলো আধুনিকায়ন ও উন্নত করা হয়েছে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এই পরীক্ষাগারগুলো অধিক মাত্রায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
তবে এত অগ্রগতির পরেও দেশে এখনও এমন কিছু কোম্পানি আছে, যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি গাইডলাইন না মেনে ওষুধ উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে। এমনকি অত্যন্ত উচ্চপ্রযুক্তিগত সুবিধায় তৈরি করতে হয় এমন সব অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন, এমনকি অ্যান্টিক্যান্সার ড্রাগও একশ্রেণির কর্মকর্তার পরোক্ষ সহযোগিতায় তৈরি করে যাচ্ছে। এদের উৎপাদনের পরিমাণ জাতীয় উৎপাদনের পরিমাপে নগণ্য হলেও এদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে নিম্নমানের প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় ঘটনায় জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির উদ্যোগে আমাকে আহ্বায়ক এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসির সিনিয়র অধ্যাপকদের সদস্য করে একটি বিশেষজ্ঞ পরিদর্শন দল গঠিত হয়, যারা নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশের সব ওষুধ কারখানার অভ্যন্তরভাগ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি গাইডলাইন অনুযায়ী পরীক্ষা করে এবং অসাধু কিছু কোম্পানির নানা প্রলোভনকে উপেক্ষা করে অত্যন্ত সততার সঙ্গে বিশদ পরিদর্শন রিপোর্ট প্রদান করে। দেশ থেকে নকল-ভেজাল-নিম্নমানের ওষুধ নির্মূলে রিপোর্টটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পর করণীয়গুলো চিহ্নিত করে এগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সংসদীয় কমিটির সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্দেশ বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে নানা ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট ও এরপর আপিল বিভাগের চূড়ান্ত নির্দেশে সরকার অবশেষে নিম্নমান, নকল ও ভেজাল ওষুধ নির্মূলে ছোট-বড় ৬২টি কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে কিছু কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল এবং অন্যদের জটিল প্রযুক্তির ওষুধ উৎপাদন স্থগিত রাখা। এতগুলো ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত এমন ইতিবাচক উদ্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম।
ফলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ওষুধ খাতের ভাবমূর্তি অনেক উন্নত হয়েছে। তবে ওষুধ খাতের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ওষুধ খাতে এ রকম ব্যবস্থা নিয়মিত এবং চলমান থাকা উচিত। ওষুধের মান রক্ষায় সরকারও কঠোর অবস্থানে রয়েছে, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব মহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ও ফার্মাসিস্টদের জন্য চলমান বছরটা ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল। কারণ এ বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালকে `ওষুধবর্ষ` হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ এ বছরের `প্রডাক্ট অব দি ইয়ার` হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ওষুধকে নির্বাচন করেছে। প্রধানমন্ত্রী ওষুধবর্ষ ঘোষণা প্রদানকালে এ কারণেই এ খাতকে নিয়ে তার প্রত্যাশার কথাও বলেছেন। আমরা ফার্মাসিস্টরা তার এই প্রত্যাশা পূরণে অংশ নেওয়ার সুযোগ চাই। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও ওষুধ চাহিদাকে সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা ফার্মাসিস্টরা সেবায় রূপান্তরিত করতে চাই।
লেখকঃ অধ্যাপক আ ব ম ফারুক
আহ্বায়ক, জাতীয় ঔষধনীতি ২০১৬ প্রণয়ন উপ-কমিটি; সাবেক চেয়ারম্যান, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ সাবেক ডিন, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
abmfaroque@yahoo.com