চাকরির চাহিদা ও শিক্ষার সমন্বয় হলে কেউ বেকার থাকবে না: আমিনুল হক
প্রকাশিত : ০৬:৫৬ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:৪৩ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনসংখ্যার বোনাসকাল পার করছে দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারেও প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ, বিশাল এ অর্জন ও সম্ভাবনার পেছনে চ্যালেঞ্জ ও তা টপকানোর উপায় কি হতে পারে। অন্যদিকে একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না।
স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে কোচিংও। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়? এসব নানাবিধ প্রশ্নের সূলক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল হকের। একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দেশ জনসংখ্যার বোনাসকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আবার স্বল্প উন্নত থেকে উন্নয়নশীলের কাতারে প্রবেশ করেছে।সবই আমাদের অর্জন।
এ অর্জনের সুফল পেতে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আমাদের দরকার সঠিক অ্যাসেসমেন্ট বা গবেষণা।গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে আমাদের দেশে কোন কোন খাত সম্ভাবনাময়।সেখানে কি পরিমান ও কি কি বিষয়ে লোক লাগবে। অর্থাৎ আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিযে বেকারত্ম ঘোচাতে দরকার চাকরির বাজারের উপর সঠিক পরিসংখ্যান।পরিসংখ্যান অনুযায়ী চাকরির চাহিদা ও শিক্ষার সমন্বয় করতে পারলে বেকারত্ম থাকবে না।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাস যুগ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অতিবাহিত করছে দেশ। এ সুযোগ বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?
আমিনুল হক: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ আমাদের জন্য খুবই সৌভাগ্যের। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি এর মূল্যায়নে আমি দেখবো-আমাদের কর্মক্ষম মানুষগুলো কর্মে নিয়োজিত আছে কি না।তাদের কর্মে নিয়োজিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা আমরা দিতে পেরেছি কি না। দেশে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার জন্য কাঠামো আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি না। কর্মক্ষম লোক কি ধরণের কাজে নিয়োজিত হবে রাষ্ট্র বা সরকার সে সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে কি না?
দেশে কি পরিমান কর্মসংস্থান হবে, দেশের বাইরে কি পরিমান কর্মসংস্থান হবে এবং কিভাবে হবে সেগুলো আমরা কর্মক্ষম মানুষের কাছে বলতে পেরেছি কি না। অর্থাৎ কর্মক্ষম লোককে কাজে নিয়োজিত হওয়ার আগে প্রস্তুতি পর্বেই তাদের এ প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে পেরেছি কি না। এই প্রশ্নের উত্তর বা সমাধানের মধ্যেই আছে জনসংখ্যার বোনাসকালের সুফল।
বাংলাদেশের ২০১৬-১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট ৩ কোটি ৩২ লাখ লোক কর্মক্ষম। কিন্তু সেই যুব জনগোষ্ঠী কি কাজ চায় এবং আমরা কি কাজ দিতে পারবো তার মধ্যে সমন্বয় করতে পেরেছি। যদি সমন্বয় না করতে পারি তবে আমাদের ব্যর্থতা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের এ সুযোগ আসলে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে?
আমিনুল হক: এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে দুইভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি।একটা হচ্ছে দেশে। অন্যটি দেশের বাইরে।দেশের ভিতরের গুলি হলো সরকারি, বেসরকারি ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে।অর্থাৎ সরকারি পর্যাযে বছরে কি পরিমান নিয়োগ হবে তা নিশ্চিত করতে হবে।বেসরকারি পর্যায়েও কি পরিমান নিয়োগ হবে তাও নিশ্চিত করতে হবে।আবার ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।যেমন আমার গার্মেন্টস খাতে কতজন লোক লাগবে।কি কি বিষয়ে লাগবে।তা নিশ্চিত করতে হবে।এভাবে আমাদের সব খাতে কি পরিমান লোক লাগবে তার হিসেব করতে হবে।দেশের যতগুলো খাত আছে সব খাতে কি পরিমান লোক লাগবে তার সুস্পষ্ট ধারণা কর্মক্ষমদের দিতে হবে। পাশাপাশি বিদেশেও কি পরিমান লোক লাগবে এবং কোন কোন খাতে লোক লাগবে তার ধারণাও স্পষ্ট হতে হবে।তবে তারা পছন্দ অনুযায়ী কর্ম বেছে নিতে পারবে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের দক্ষও করে তোলার সুযোগ পাবে।
আমরা এখনও কোন গবেষণা করি নাই যে আগামী ২০২৫ সাল বা ২০৩০ সালে দেশে কোন কোন খাতে বেশি লোক লাগবে। কি পরিমান লোক লাগবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে আরও ৮০ হাজার বেকার বেড়েছে। দেশের এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা কেন কাজে লাগাতে পারছি না? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না?
আমিনুল হক: ওই যে চাকরির বাজারের উপর আমাদের কোন গবেষণা নেই। ফলে একটা ছেলে অনার্স-মাস্টার্স পাসের পর ১০টা চাকরিতে আবেদনের পর যখন সে চাকরি পাচ্ছে না। তখন সে বিদেশ বেঁছে নিচ্ছে। অথবা উদ্যোক্তা হচ্ছে। এখন যদি হিসেব থাকতো যে দেশে আর কোন চাকরির পদ খালি নাই। তবে সে সময় নষ্ট না করে লেখা-পড়া শেষ করেই বিদেশ, উদ্যোক্তা বা কোন ব্যবসা বেঁছে নিতো।অথবা গবেষণা অনুযায়ী যদি জানানো যেত তাদের এই এই খাতে লোক নেয়া হবে। তখন তারা সে অনুযায়ী লেখা পড়া করে সহজেই চাকরি পেত। বেকারত্মও কমতো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: তবে কি চাকরির বাজার চাহিদা অনুয়ায়ী শিক্ষার্থীরা লেখা-পড়া না করার করাণে-ই বেকারত্ম বাড়ছে?
আমিনুল হক: একেবারে-ই তাই।চাকরির বাজারে যে পরিমান লোক দরকার আর আমরা যে পরিমান সনদ দিচ্ছি, তারমধ্যে সামাঞ্জস্যতা নেই।আমাদের দেশে যদি বেসরকারি ৬৭টি আর সরকারি যদি ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় ধরি। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় প্রতিবছর কতজন ভর্তি করানো হচ্ছে। ইংরেজিতে কতজন ভর্তি করানো হচ্ছে। কতজন সেখান থেকে পাস করে বের হচ্ছে।সেটা কি দেশ ও বিদেশের চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী হচ্ছে।তার কোন হিসেব আমাদের কাছে নেই।এ হিসেবে না জানার কারণে অনেকে শিক্ষিত হচ্ছে, সনদ নিচ্ছে, কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে যেটা দরকার নেই। সেই বিষয়ে শিক্ষা লাভ করা হচ্ছে।শেষমেষ সে শিক্ষা তার কর্মজীবনে কাজে লাগছে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: চাকরির বাজার চাহিদা বিবেচনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমিনুল হক: বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো বিষয়-ই কর্মমুখী না। জ্ঞান অর্জনের জন্য সবগুলি ঠিক আছে। কিন্তু তার সবগুলো কর্মোপযোগী না।শিক্ষাকে কর্মমুখী করতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে দেশে কি পরিমান ও কোন কোন বিষয়ের লোক লাগবে। তা জানার পর পাঠ্য বইয়ে সে বিষয়গুলির সন্নিবেশ ঘটাতে হবে।তবেই শিক্ষার্থীরা একাডেমিক লেখা-পড়া শেষ করেই কর্মে ঢুকতে পারবে। তাদের কোন অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া লাগবে না।
আমাদের একটি ছেলে বা মেয়ে যখন গ্রাম থেকে স্কুল কলেজ কৃতিত্বের সাথে পাস করে ভালো রেজাল্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসে। সে বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো রেজাল্ট করে।কিন্তু সে যখন বের হয়ে যায় তখন তার মলিন মুখে তাকানো যায় না।কারণ সে সময় নিজেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে।তারা বলে, স্যার এখন তো নিজেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস একটা মেয়ের চেয়েও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করি।কারণ পৃথিবীর সব রঙ দেখলাম। কিন্তু আমার এখন কোন কিছু নেই।আপনারা এতোদিন বলেছেন চাকরি নিতে শিক্ষা অর্জন করতে হবে।শিক্ষার শেষ পর্যায়ে এসে আমার চাকরি নাই। বয়স নাই। আমাকে ঘিরে পরিবার-পরিজনের স্বপ্নও ধূসর হয়ে যাচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে পর্য্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। পর্য্যবেক্ষণকালে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে গিয়ে আমাদের কী ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা লাগতে পারে এবং সে চ্যালেঞ্জগুলো টপকানোর উপায় কি?
আমিনুল হক: আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পর্যবেক্ষণের তালিকায় উঠেছি। এটা আমাদের একটা অর্জন। এখান থেকে পেছানোর কোন সুযোগ নেই।তবে সামনে যে আমাদের অনেকগুলো ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে।যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন। বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি।রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা।
/ এআর /