ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

কাটাছেঁড়া ও ব্যথামুক্ত নিরাপদ প্রসব ইপিডুরাল: ডা. ফয়েজা আক্তার

প্রকাশিত : ০৭:৫২ পিএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৪:৩২ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার

ডা. কাজী ফয়েজা অাক্তার

ডা. কাজী ফয়েজা অাক্তার

প্রসবকালীন ব্যথায় ভয় অন্তঃস্বত্ত্বা নারীদের। আর এই সুযোগ নিয়ে প্রসবকালীন ব্যথা থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলে বাড়ছে সিজার। এতে নারীর দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি থাকছে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও।

চিকিৎসকদের তথ্যানুযায়ী অনুযায়ী গত দশ বছরে সিজারের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণ। এর ফলে একদিকে যেমন মাতৃমৃত্যু হার বাড়ছে অন্যদিকে সিজার পরবর্তী সময়ে মায়ের শরীরে দেখা দেয় নানা সমস্যা।

উন্নত বিশ্বে সিজারকে অনুৎসাহিত করতে ‘ইপিডুরাল প্রসব পদ্ধতি’ চালু হয়েছে বহু আগেই। বাংলাদেশেও ইপিডুরাল পদ্ধতি চালু হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে।

গত এপ্রিলে রাজধানীর তেজগাঁয়ের ইমপালস পাসপাতালে ইপিডুরাল প্রসব পদ্ধতি চালু হয়। এই হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ত্রিশ জন অন্ত:স্বত্ত্বার সন্তাব প্রসব হয়েছে এই পদ্ধতিতে।

দিন দিন এই চিকিৎসার চাহিদা বাড়ছে। সচেতন নারীরা এখন ব্যথামুক্ত প্রসবের জন্য ইপিডুরাল পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন। ইপিডুরাল প্রসব পদ্ধতি সম্পর্কে  একুশে টিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন ইমপালস হাসপাতালের গাইনী, প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার এমবিবিএস,এমসিপিএস, এফসিপিএস। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ইপিডুরাল প্রসব পদ্ধতি সম্পর্কে যদি ধারণা দিতেন?

ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার: ইপিডুরাল একধরনের স্বাভাবিক প্রসব। এতে সবকিছুই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রেখেই সন্তান প্রসব করানো হয়। কোনো সিজার বা অস্ত্রোপ্রচারের দরকার পড়ে না।

তবে অন্যান্য স্বাভাবিক প্রসবে মায়ের যে ব্যথা হয়, এখানে সেই ব্যথা হবে না। মা কোনো ধরনের ব্যথা অনুভব ছাড়াই সন্তান প্রসব করবেন। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে এ্যানেস্থেসিয়া। ডাক্তার এক্ষেত্রে একটি ছোট ইনজেকশন কোমরে দেন। এটাকে বলে ইপাডুরাল এ্যানেস্থেসিয়া।

এই ইনজেকশান দেওয়ার ফলে রোগী কোনো ধরনের ব্যথা অনুভব করেন না। কিন্তু বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে নিচে নামা, স্বাভাবিকভাবে প্রসব হওয়া, এসব ক্ষেত্রে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না। এটা একটি লোকাল এ্যানেস্থেসিয়া। কোমরের ওই জায়গাটাতে লোক্যালি কাজ করবে। আর কিছুই না।

এই ইনজেকশন দেওয়ার পর রোগী স্বাভাবিক হাঁটা চলা করতে পারবেন। ওয়াশরুমে যেতে পারবেন। তিনি তার সন্তানের মুভমেন্ট বুঝতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে সারাক্ষণ এই রোগীকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পুরো প্রক্রিয়াটা আপনারা কীভাবে সম্পন্ন করেন?

ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার: আমরা সেক্ষেত্রে যা করছি, আমি একজন কনসালটেন্ট, সঙ্গে আমার রেজিস্ট্রার, আমার মেডিক্যাল অফিসার, একজন নার্স এবং একজন এ্যানেস্থেলোজিস্ট, আমরা সবাই মিলে সর্বদা পেশেন্টকে মনিটর করি। বাচ্চার হার্টবিট, মায়ের জরায়ুর অবস্থা, জরায়ুর মুখ কেমন খুলে গেল ইত্যাদি দেখা হয়।

এছাড়া ইপিডুরাল দেওয়ার ফলে মায়ের ব্লাড প্রেসারসহ অন্যান্য সব দিকগুলো ঠিক আছে কি-না সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হয়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্বাভাবিক প্রসবে মা একটা ব্যাথা অনুভব করেন। ইপিডুরাল পদ্ধতিতে কী মা সেই ব্যথা অনুভব করেন?

ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার: হ্যাঁ, এখানে দুটো ব্যাপার আছে। একটা হতে পারে, তার ( মায়ের) ব্যথাটা হয়তো বাসা থেকে শুরু হলো। ব্যথা উঠার পর মা এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন। এটা একটা ব্যাপার হতে পারে। আর ব্যথা উঠা মানেই কিন্তু প্রসব হয়ে যাওয়া না। অনেকের একটা ভুল ধারনা আছে। তারা ভাবেন, আমি উত্তরায় থাকি, নারায়নগঞ্জ থাকি। ব্যথা উঠলে আমি কীভাবে এতদূরে আসব? আমি যেটা বলি ব্যথা উঠার পরে যে ফেজটা তাকে আমরা দু`ভাগে ভাগ করি। একটা হলো ল্যাটেন্ট ফেজ, আরেকটা হলো এ্যাক্টিভ ফেজ।

 এ্যাক্টিভ ফেজটা মোটামুটি ফিক্সড। ছয় থেকে সাত ঘন্টা। বাট ল্যাটেন্ট ফেজ কিন্তু ফিক্সড না। সেক্ষেত্রে মায়ের যখন ব্যথা উঠবে তখন সে মোটামুটি সাত আট ঘন্টা সময় পায় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কাজেই সে দূর থেকেও আমাদের এখানে আসতে পারে। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হতে পারে। তার ডেট অনুযায়ী সবকিছু ওকে। এরপরও ব্যথা উঠল না। আমরা সাত দিন অপেক্ষা করলাম। সেক্ষেত্রে আমরা তাকে হসপিটালে এ্যাডমিট করিয়ে মেডিসিনের মাধ্যমে ব্যথা উঠালাম। যখন সে ব্যথাটা ফিল করল, জরায়ুর মুখটা খুলতে থাকল তখন একটা পর্যায়ে এসে মা বলবে, না আমি আর ব্যথা সহ্য করতে পারছি না। তখন আমরা তাকে ইপিডুরাল এ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে দিলাম।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ইপিডুরাল পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব হলে পরবর্তীতে কোন ধরণের পার্শ প্রক্রিক্রিয়া দেখা দেয় কি?

ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার: এটা তো একটা লোকাল এ্যানেন্থেসিয়া। সমস্যা যতি কিছু হয়েই থাকে এ্যানেস্থেসিয়াকালে হতে পারে। হয়তো মায়ের ব্লাড প্রেসার ফল করতে পারে। বা এ্যানেন্থেসিয়া দেওয়ার পরও ৯০ ভাগ হয়তো ব্যথা মুক্ত হয়েও ১০ ভাগ ব্যথা করল। এরকম কিছু ব্যথা হতে পারে। তবে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ম্যানেজ করে ফেলেন। এবং সত্যি কথা হচ্ছে এক্সপার্ট হ্যান্ডে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। প্রসবের পরে ডাক্তার শুধু এপিডুরাল টিউবটা বের করে নিয়ে আসেন। এরপর আর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ইপিডুরাল পদ্ধতিতে প্রসব কেমন ব্যায় সাপেক্ষ?

ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার: ইমপালস হাসপাতালে ব্যথামুক্ত সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে সব মিলিয়ে ৪৫ - ৫০ হাজার টাকার মধ্যে খরচ পড়ে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন : ইমপালস হাসপাতাল ছাড়া এই সুযোগ আর কোথায় কোথায় পাওয়া যাবে?

ডা. কাজী ফয়েজ আক্তার: দেশের আরো কিছু কর্পোরেট হাসপাতাল এই প্রক্রিয়া চালু করেছিল। কিন্তু আমরা যেভাবে প্রচার করি বা সাড়া পাচ্ছি- যেমন প্রতিদিন পাঁচ ছয়জন মা বুকিং নিচ্ছেন এতো বেশী মাত্রায় অন্য কোন হাসাপাতাল চালু করেনি। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা (গত এপ্রিল থেকে) ৩০ জন মায়ের ডেলিভারী করিয়েছি। বিশেষ করে আমাদের হাসপাতালের শ্রদ্ধেয় এমডি স্যার- প্রফেসর জহির আল-আমিন স্যারের একান্ত ইচ্ছা ও সহযোগীতায় আমাদের পক্ষে ১০০% সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোন মাকে ইপিডুরাল পদ্ধতিতে স্বাভাবিক প্রসব করানো সম্ম্ভব হয় না?

ডা.কাজী ফয়েজা আক্তার: কখনো কখনো মায়ের স্পেস এবং বাচ্চার সাইজ হয়তো একটু উনিশ বিশ থাকে। মনে হয় ব্যথা উঠলে হয়তো চলে আসতেও পারে। সেক্ষেত্রে আমরা ট্রাই করি।

কিন্তু দেখা গেল ব্যথা উঠার পর জরায়ুর মুখও খোলে। কিন্তু বাচ্চার মাথা নামছে না। তখন আমরা বাচ্চার অবস্থা খারাপ বুঝতে হার্টবিট পরীক্ষা করে তৎক্ষনাৎ সিজারে যাই। এক্ষেত্রে মায়ের একটা সান্ত্বনা থাকে যে, তিনি অন্তত চেষ্টা করেছেন। আমাদের সান্ত্বনা থাকে, অপ্রয়োজনে কারো সিজার করিনি। না বললেই নয়, ইমপালস হাসপাতালে এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে সিজারে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।

ডা. কাজী ফয়েজা অাক্তার: আপনাকেও ধন্যবাদ। পাশাপাশি সবাইকে অাহবান করব, সিজারের ঝুঁকি না নিয়ে ব্যথামুক্ত সন্তান প্রসবের জন্য ইপিডুরাল প্রসব পদ্ধতি গ্রহণ করুন। মা ও বাচ্চার জীবন নিরাপদ রাখুন।

/ এআর /