ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একান্ত সাক্ষাৎকারে মাহফুজা খানম

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাকার জন্য শিক্ষাকে টার্গেট করেছে

প্রকাশিত : ০৭:৩৭ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

বাংলাদেশে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক অনবদ্য নাম অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম । ছাত্র জীবন থেকেই শিক্ষার প্রসার ও শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে ছিলেন আগ্রসৈনিক। ১৯৬৬ সালে হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) প্রথম নারী ভিপি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। একইসঙ্গে বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের দ্বিতীয় মেয়াদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। এছাড়া খেলাঘরসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সনের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বেকারত্ম-কর্মসংস্থান ও ছাত্রদের নীতি-নৈতিকতাবিষয়ক তিন পর্বের বিশেষ এ সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।

 

 

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাগামহীন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাণিজ্যের এ বেড়াজাল থেকে কিভাবে বের করে আনা যেতে পারে?

মাহফুজা খানম: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রান্টস কমিটি দিচ্ছে। সেখানে শিক্ষার বদলে হচ্ছে ব্যবসা। ব্যবসা করার জন্য আমরা শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছি। এর চেয়ে দুঃখের ও লজ্জার কি হতে পারে। যিনি পড়াচ্ছেন, তিনি প্রশ্ন করছেন, তিনিই খাতা দেখছেন, আবার তিনিই আমার ডিগ্রি দিয়ে দিচ্ছেন। বিষয়টি এমন হয়েছে- আমি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আরো ছাত্র চাই। আরো টাকা চাই। যার কারণে একই ব্যক্তি পড়াচ্ছেন, পরীক্ষা নিচ্ছেন ও মূল্যায়ন করছেন। আমি জানি না গ্রান্টস কমিশন কতটুকু এটার লাগাম টানতে চেষ্টা করছেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কোচিং সেন্টারগুলো তাদের সে আগ্রহকে পুঁজি করে বেপরোয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যা সরকার বারবার ঘোষণা দিয়েও বন্ধ করতে পারছে না। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

মাহফুজা খানম: এরই মধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি যে শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছিল- ‘এসো নিজে করি’। যেখানে কিছু সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে। তারপর তাদের উপর আনা হলো সৃজনশীল পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষকরাই জানতে পারলো না সৃজনশীলতা সম্পর্কে। সেখানে ছাত্ররা কিভাবে ভালো করবে। শিক্ষক ও ছাত্ররা যখন বুঝতে পারছেন না, তখন অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটছেন। কার কাছে গেলে তার বাচ্চাকে শেখানো যাবে এ চিন্তায় তারা ব্যস্ত থাকছেন। তারা কোচিংয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন। ফলে কোচিং বাণিজ্যও রমরমা হয়ে উঠছে। কোচিংগুলোতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রদের রেজাল্ট ভালো করতে তারা অসদুপায় অবলম্বন করে প্রশ্নফাঁসে জড়িয়ে পড়ছে। যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এভাবে তো চলতে পারে না। তাই আমাদের গোটা শিক্ষা পদ্ধতিকেই ঢেলে সাজাতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?

মাহফুজা খানম: মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ছেলে-মেয়েদের তৈরি হচ্ছে না। যেভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম নানা ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত হচ্ছে। অপকর্মের মধ্যে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরাও আশঙ্কাজনক হারে জড়িয়ে পড়ছে। তারা মাদক সেবনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাতে নানা ধরণের সামাজিক সমস্যা তারা সৃষ্টি করছে। কিন্তু আগে আমাদের সময় ছাত্র সমাজ-ই ছিল মানবিক মূল্যবোধের সোপান। আমরাই তো ছয় দফা দিয়েছেলাম। মানুষ সেগুলো গ্রহণ করতো। এখন শোনা যায় ছাত্ররা চাঁদাবাজিও করে। আবার তারা দেশ ও জাতিকে নিয়ে ভাবে না। তাদের আন্দোলনও এখন পূর্ণমাত্রায় জাতির স্বার্থে হয় না। জাতিও তাদের উপর ভরসা রাখতে পারে না। কারণ ছাত্রদের মাঝে সেই মানবিকতা নেই। আজ আমাদের তরুণ সমাজ যেন অপরাধে ডুবে গেছে। ছেলে-মেয়েদের জীবনবোধ সম্পর্কে যেমন ধারণা বা আচরণ থাকা উচিত, তেমনটি পাওয়া যাচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের কথা।
ঢালাওভাবে যদি এ কথা না বলি তবে বলবো হ্যা কিছু ছেলে-মেয়ে এখনও ভালো আছে। ভালো করছে। তবে তারা এক পাসে চলে গেছে। আমি বলবো যারা আমাদের সমাজপতিরা আছেন, যারা শিক্ষক আছেন, যারা আগামীতে পথ দেখাবেন, তারা যেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোথায় কোথায় গলদ আছে, তা নিয়ে ভাবেন। এই গলদগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জোর দাবি উঠেছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে। তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক মনে করছেন?

মাহফুজা খানম: এখন সেশনজট আগের মতো নেই। ৩৫ বছরে যদি একটি ছেলে বা মেয়ে চাকরি জীবনে ঢোকে। তো সে জীবনে অন্য কাজগুলো কিভাবে করবে? তার একটা সংসার জীবন হবে। তার পেশাগত জীবন হবে। তাকে দক্ষ ও পেশাদারি হতে হবে। যদি ৩৫ বছরে চাকরিতে প্রবেশ করে তবে এ দক্ষ হওয়ার সময়টা কখন পাবে? আমি তো চাকরিতে ঢুকেছিলাম ২২ বছরে। আমি মনে করি ৩০ বছর-ই যথেষ্ঠ।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীরা দাবি তুলেছে। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিভাবে দেখছেন তাদের এ কোটা সংস্কার দাবিকে?

মাহফুজা খানম: তুমি ভালো ছাত্র- আর আমি খারাপ, কিন্তু কোটার কারণে আমি চাকরি পেলাম। তুমি বেকার থাকলে এটা হতে পারে না। আমি মনে করি মেধাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে। কোটা পিছনে পড়ে থাকাদের জন্য থাকতে পারে। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকতে পারে। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এ কোটা কখনও কাজে লাগায়নি। সার্টিফিকেটও নেয়নি। আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে চাই-যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা মুক্তিযোদ্ধা ও তার সন্তানদের ক্ষেত্রে ঠিক আছে। অর্থাৎ নাতি-নাতনী পর্যায়ে সঠিক নয়। আমার কথা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান সম্মানের জায়গাতে থাকবে। তাদের অর্থ দেয়া হচ্ছে, বাড়ি করে দেয়া হচ্ছে, আরো কিছু দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোটা রাখা হবে এটা আমি একেবারেই সমর্থন করি না।

এমজে/