দক্ষতা বাড়াতে শিক্ষাকে করতে হবে আন্তর্জাতিক মানের: মাহফুজা খানম
প্রকাশিত : ০৪:৪২ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার
অধ্যাপক মাহফুজা খানম। ১৯৬৬ সালে যিনি ছিলেন ডাকসুর ভিপি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। বর্তমানে বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের দিত্বীয় মেয়াদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। এছাড়া খেলাঘরসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সনের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বেকারত্ব-কর্মসংস্থান, ছাত্রদের নীতি-নৈতিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনসহ নানাবিধ দিক নিয়ে বরেণ্য এ শিক্ষাবীদের মুখোমুখী হয়।
তিন পর্বের বিশেষ এ সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে আরও ৮০ হাজার বেকার বেড়েছে। দেশের এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা কেন কাজে লাগাতে পারছি না? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না?
মাহফুজা খানম: আজ বাংলাদেশে চাকরি নাও পাওয়াটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ লাভ করেছিলাম। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন যে শিক্ষা ছাড়া একটি জাতিকে তিনি দাঁড় করাতে পারবেন না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে জাতি একটা শিক্ষার ভিতর দিয়ে বিশ্বপ্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করবে। সেই কারণেই তিনি কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশন করলেন। ড. কুদরহ এ খুদাকে নিয়ে ১৯৭৩ সালে শিক্ষা কমিশন হলো। এটা প্রকাশিতও হলো। কিন্তু কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন। ফলে কমিশনের বাস্তবায়নটা থমকে গেলে।
এরপর যারা ক্ষমতায় এলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করতেন না। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে তাদের অবস্থান ছিল। যে কারণে পরবর্তীতে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে। কিন্তু এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থাটা কি হবে? সেই শিক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন দিয়েছেন। কিন্তু তা কতটা কার্যকরী তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ড. কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশন বলেছিল একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে। ভোকেশনাল বা কারিগরি শিক্ষা অবর্শই থাকতে হবে। এ কারিগরি শিক্ষায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। কারণ সব তরুণ যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে সেটা দরকার ছিল না। তাই ৬০ শতাংশ যদি আমার সাধারণ শিক্ষা হয় তবে ৪০ শতাংশ আমি কারিগরি শিক্ষায় নেব। আমরা সে সময় নতুন জাতি হিসেবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমরা সে সময় একটা ভগ্নদশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। সে সময়ের কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশনের ভিতর দিয়ে শিল্প ও কৃষি প্রত্যেকটা বিষয়ের কারিগরি শিক্ষাকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেটা সম্ভব হয়নি।
এরপরে আমরা দেখলাম আমাদের শিক্ষায় ৩টা দিক চলে এলো। প্রথমটি হলো সাধারণ শিক্ষা। দ্বিতীয়টি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। তৃতীয়টি হলো ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা। শিক্ষার এ তিন ধারায় তরুণ প্রজন্মকে বিভাজিত করা হলো।
যেমন মাদ্রাসা শিক্ষাগুলোতে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া শুরু হলো।যেখানে আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান কোথায় গিয়েছে তার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। তারা আর একটা পিছনের দিকের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে।
আর একটা হলো ইংরেজি মাধ্যম। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েরা ও লেভেল, এ লেভেল সম্পন্ন করছে। এরপর তারা এদেশে থাকছে না। তারা এদেশে জন্মেছে। এ দেশের বায়ু নিচ্ছে, শ্বাস গ্রহণ করছে। খাদ্য খাচ্ছে। বড় হচ্ছে। তারপর অন্য দেশ নিয়ে ভাবছে।
কারণ তাদের শিক্ষা কারিকুলামে নজরুল নাই। সুকান্ত নাই। রবীন্দ্রনাথ নাই। বঙ্কিম চন্দ্র নাই। ফলে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক –বাহক কিন্তু তারা হচ্ছে না। তারা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অবহে গড়ে উঠছে। এদের শিকড়টা বাংলাদেশে হলেও পাস করার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশই তাদের পছন্দের জায়গা হচ্ছে।
আর থাকলো সাধারণ শিক্ষা। এখন সাধারণ শিক্ষা আসলে কত শতাংশ এ শিক্ষায় শিক্ষিত। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সাধারণ ছাত্রদেরও যে সিলেবাস তাতে ছাত্রদের সঙ্গে যেন একটা গিনিপিকের মতো আচারণ করছে। এ বাচ্চাগুলোকে নিয়ে চলছে একটার পর একটা পরীক্ষা। না তারা সিলেবাসের বিষয় আত্মস্থ করতে পারছে। না তারা প্রফুল্ল চিত্তে লেখা-পড়া করছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
মাহফুজা খানম: যে শিক্ষা ব্যবস্থাটি আজকে আমাদের দেশে চালু রয়েছে, সেটা অবশ্যই জ্ঞানের। তবে সেটা কোনভাবেই পরবর্তী জীবনে ব্যবহারের নয়। আমাদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে, সেটা আমরা বাধ্য হয়ে গ্রহণ করছি। এটা আমাদের আশা আকাঙ্খার জায়গা পূরণ করতে পারছে না। এ শিক্ষায় যদি আমাদের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে নিতে না পারে। তবে ভবিষ্যৎ তো আমাদের কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আমি বলবো যথেষ্ঠ দেরি হয়ে গেছে। এখন আমাদের সময় এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনার। আমাদের বড় সম্পদ আমাদের তরুণ সমাজ। এদেরকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তারা যেন দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিছুদিন আগে আমরা লক্ষ্য করলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের পরীক্ষায় মাত্র ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ পাস করেছে। পাসের এ হারকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
মাহফুজা খানম: দেখুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তারাই অংশ নিয়েছিল যারা এসএসসি ও এইচএসসিতে এ প্লাস, গোল্ডেন প্লাস বা ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন এমন একটি পরীক্ষায় যদি ৮৯ দশমিক ১১ শতাংশ পাসই না করে। তবে কি আমি বলবো যে উচ্চ শিক্ষায় আমার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে? বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে সোনার বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেটা পূরণ হচ্ছে? না। মেধার কোথাও না কোথায় ঘাটতি রয়েই গেছে। যার কারণে এটা হলো। এটার জন্য তৎপর হওয়া দরকার। আমাদের ঘাটতি খুঁজে বের করে তা দূর করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের সঠিকভাবে শিক্ষা বা জ্ঞান পাওয়ার সুযোগ করতে হবে।
/ এআর /