ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৯ ১৪৩১

ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় ৫৬ নেতা হারিয়েছে দেশ: মাহফুজা খানম

প্রকাশিত : ০৬:০২ পিএম, ২ অক্টোবর ২০১৮ মঙ্গলবার

অধ্যাপক মাহফুজা খানম। ১৯৬৬ সালে যিনি ছিলেন ডাকসুর ভিপি। বর্তমানে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। বর্তমানে বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের দিত্বীয় মেয়াদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। এছাড়া খেলাঘরসহ বিভিন্ন সামাজিক  ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সনের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বেকারত্ম-কর্মসংস্থান, ছাত্রদের নীতি-নৈতিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনসহ নানাবিধ দিক নিয়ে বরেণ্য এ শিক্ষাবীদের মুখোমুখী হয় । তিন পর্বের বিশেষ এ সাক্ষাৎকারটির শেষ পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ডাকসু ভিপি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন আপনি। কেমন ছিল আপনাদের সময়ের ডাকসু কার্যক্রম?

মাহফুজা খানম: ১৯৬৬-৬৭ সালে ডাকসুর ভিপি হই। ডাকসুর ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত একমাত্র নারী  ভিপি আমি। ডাকসুর জন্মলগ্ন থেকেই এটার দ্বিমুখী কাজ ছিল। একটি ছিল রাজনৈতিক। অন্যটি ছাত্র বা ছাত্রীদের সমস্যা নিয়ে একাডেমিক কাজ।

আমাদের সময়ে ১৯৬৬ সালে ছয়দফা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ছয়দফাকে কিন্তু ক্যারিআউট করেছি আমি। সেই টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত কত জনসভা করেছি। এমনকি পল্টনেও একুশে ফেব্রুয়ারি আমার সভাপতিত্বে আমরা জনসভা করেছি। সেটাতে আটক হয়েছি। আমাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া বেরিয়েছে। আমি, তোফায়েল, রাজ্জাক ভাই, রব ভাই, খালেদ মোহাম্মদ আলী, জামাল হায়দার এ রকম আটজনের বিরুদ্ধে আমাদের হুলিয়া বেরিয়েছিল। যাহোক সেটা অন্য কথা।

ডাকসুর মূল কাজ হচ্ছে ছাত্রদের দাবি দাওয়া। কি কি বিষয়ে তারা সমস্যায় আছে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা। এছাড়া তাদের এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিসগুলো চালিয়ে নেওয়া। সে সময়ে আমাদের প্রত্যেকটা হলে যে সংসদ ছিল তারা প্রতি সপ্তাহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতো। সেখানে কবিতা আবৃতি, গান, নাটক ও স্মরণিকা বের হতো। নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ নানা ধরণের দেশত্ববোধক গান হতো। একটা হলের সঙ্গে আর একটা হলের মধ্যে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করতো ডাকসু। এ সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে একজন তরুণ ও তরুণী একাডেমিক লেখা-পড়ার পাশাপাশি বাহিরের জগৎ সম্পর্কে জানতে পারতো। মনোজগৎকে একটা আলোকিত জায়গায় নেওয়ার সযোগ পেত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন:  ডাকসুর সেই কার্যক্রমে দেশ কতটুকু উপকৃত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মাহফুজা  খানম:  ডাকসুর সেই অবদানের কারণেই আজকে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, রামেন্দ মজুমদার, ফেরদৌসি মজুমদার এ রকম অনেকেই তৈরি হয়েছেন। এছাড়া কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তারাও কিন্তু ডাকসুর তৈরি। তারা ডাকসু থেকে নেতৃত্ব শিখতে পেরেছে। যার কারণেই তো তারা আজ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আজকে যে মেনন ভাই, তিনি আমার দুই বছর আগে ডাকসুর ভিপি ছিলেন। আর মতিয়া আপা জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমার আগে ডাকসুর ভিপি ছিলেন ফেরদৌস কোরেশি। এসবের মধ্য দিয়ে কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন বিরাট একটি অংশ বেরিয়ে এসেছে। সেখানে নেতৃত্বের অনুশীলনে ডাকসু বিরাট একটি ভূমিকা  রেখেছে।

আজকে চিন্তা করতে পারি যে গত ২৮ বছরে দেশ ডাকসুর ৫৬ জন নেতাকে হারিয়েছে। অর্থাৎ গত ২৮ বছরে যদি নির্বাচন হতো, তবে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি মিলে মোট ৫৬ জন যোগ্য নেতা দেশে তৈরি হওয়ার সুযোগ পেতো। সে হিসেবে আমরা ৫৬ জন নেতাকে হারিয়েছি। যেটা আমাদের জাতির জন্যে কখনও শুভ নয়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন:  ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

মাহফুজা খানম:  এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বার সিনেট সদস্য আমি। আমি প্রত্যেকটা সিনেট অধিবেশনে এই প্রস্তাবটি দেই যে, আপনারা ডাকসুর নির্বাচন করুন। কেন নির্বাচন হচ্ছে না সেটাও বলুন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার প্রস্তাবে কি ধরনের উত্তর পাওয়া গেছে?

মাহফুজা খানম: নির্বাচন হতে হলে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলরের ও কিছু ভূমিকা রাখার ব্যাপার আছে। ভিসি যদি সরকারের আজ্ঞাবহ হয়, তবে তো নির্বাচন হবে না। সরকার যখন মনে করবে সেখানে নির্বাচন দিলে তার প্রার্থী আছে। সে জয়ী হয়ে আসবে। তখন দিবে। আর যদি না দেয় তো ভিসি তার জন্য নির্বাচন চেতে পারে। কিন্তু তিনি যদি আজ্ঞাবহ হন তবে তা কখনও হবে না।

বিষয়টি হয়েছে এমন যে, আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনভাবে চালাবো। আমার যে প্রয়োজন আছে ডাকসুর। আমার যে প্রয়োজন আছে হল সংসদগুলোর। এ রকম  ভিসি নেই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: তাহলে কি নির্বাচন কি আদেও হবে না?

মাহফুজা খানম:  আজ ছাত্র সমাজ যে একটা সংঘাতময় অবস্থানে আছে। এ সংঘাতময় অবস্থা থেকে এ ইলেকশনগুলো করতে হলে সরকার ও প্রশাসনের একটা সহযোগিতা দরকার। কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটতেই পারে। কারণ আমি মনে করি আজকে ২৮টি বছর ছাত্র সমাজের চরিত্র হরণ করা হয়েছে। কারণ আগে যারা ছিল ছাত্রদল তারা হলগুলোকে দখল করে রেখেছিল। আজ যে সরকার তাদের ছাত্র সংগঠন সেই হল দখল করে রেখেছে। সেখানে আর ছাত্রদল ঢুকতে পারছে না। তো এটাতো হতে পারে না।

একটা ছাত্র তার আদর্শ কোথায় থাকবে। কিসে সে বিশ্বাস করবে। সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। সে ছাত্রদল করতে পারে। ছাত্রলীগ করতে পারে। আবার ছাত্র ইউনিয়নও করতে পারে। কিন্তু তাদেরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চেটিয়াভাবে রাখা যাবে না।

একটা বিষয়ে আমি ভীষণ কষ্ট পাই। যেটা আমি বিভিন্ন জায়গাতে বলি। সেটা হলো হলগুলোতে যে প্রভোস্ট আছে। তাদের কোন কর্তৃত্ব থাকে না। আমাদের সময় হল প্রভোস্ট কোন ছাত্র বা ছাত্রীর কি সমস্যা তা দেখতো। আজ সে সমস্যা দেখে ছাত্ররা। আর ছাত্র সংগঠনটি ছাত্র ওঠাতে গিয়ে টাকার লেনদেন করে। যা এখন অপেন সিক্রেট। আর এটা বছরের পর বছর চলছে।

আমি সম্প্রতি জসিম উদ্দিন হলে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজন প্রভোস্টকে জিজ্ঞাসা করলাম। তোমরা রিজাইন দাও না কেন? চাকরি ছাড়লে তোমরা কি না খেয়ে মরে যাবা? কারণ শিক্ষকরা হচ্ছে জাতির বিবেক। তারা যেখানে ছাত্র উঠানো দায়িত্ব পালন করবে। সেখানে তাদের দায়িত্ব পালন করছে ছাত্ররা। শুধু তাই না। ছত্ররা টেন্ডারবাজিও করছে। চাঁদা উঠাচ্ছে। টাকা নিয়ে হলে সিট দিচ্ছে। এখন আগামীতে যারা দেশের হাল ধরবে। তারা যদি এতোটা দুর্নীতিবাজ হয়। তবে দেশ চলবে কিভাবে।

তবে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দিয়েছিল যে আমার ডাকসু নির্বাচন হতে হবে। সে ৬ মাস পেরিয়ে গেল নির্বাচন হল না। তারপর আবার নির্দেষনা দেওয়া হলো কয়েকটি সংগঠন সম্প্রতি মিটিং করলো। সেখানেও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত এলো না। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এতো তাড়াতাড়ি ডাকসু নির্বাচন সম্ভব না। এটা করতে হলে একটা প্রকৃক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সে জন্য সময় লাগবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ডাকসুকে আগামীতে কোন জায়গায় দেখতে চান?

মাহফুজা খানম: আমি যখন  ডাকসুর ভিপি ছিলাম। আমাদের টাকা পয়সার এমন লেনদেন ভাবনাই ছিল না। আমার মনে পড়ে আমাদের ইশতেহার ছাঁপা হয়েছিল।  ওটা আনতে পারছিলাম না। টাকা ছিল না। তাই নিজের হাতের ঘড়ি বন্ধক রেখেছিলাম। সেই বন্ধকের টাকা দিয়ে ইশতেহার এনেছিলাম। বাড়ি গেলে মা বলেছিল তোমার হাতে ঘড়ি কই? জানতে পেরে তিনি টাকা দিয়েছিলেন। পরেরদিন টাকা ফেরৎ দিয়ে সেই ঘড়ি ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। আমরা যেখানে নিজেদের পয়সা খরচ করে ছাত্র সংগঠন করেছি। আজকে সেইখানে কি হচ্ছে? ঠিক তার উল্টা দৃশ্য। আজকে একটি পদ পেতে লাখ লাখ টাকা খরচ করছি। আবার পদে গিয়ে সেই টাকা উঠাতে গিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছি। এসব জায়গাগুলোতে আমার খুবই দুঃখবোধ আছে। আমি জানি না কেন সরকার এগুলো বন্ধ করে না।

আমি বলবো এই সরকার অনেক কিছু করেছে। অনেক কিছু করবেন আরও আশা করি। আমাদের রাজনীতির একটা আদর্শ থাকতে হবে। যে আদর্শ আমাদের সময় ছিল।

 

এসএইচ/