অপচয় কমিয়ে ১৫ ভাগ বিদ্যুৎ বাড়ানো সম্ভব : বিশ্বব্যাংক
প্রকাশিত : ১১:১৩ পিএম, ২ অক্টোবর ২০১৮ মঙ্গলবার
অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর ভর করেই বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়া আরও দ্রুততর করতে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার ভারতের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ এবং বিশ্ব গড়ের তুলনায় ১০ ভাগের একভাগ। উৎপাদনে দক্ষতা বড়ানো গেলে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তি বিদ্যুতের ব্যবহার সম্ভব।
মঙ্গলবার বাংলাদেশের উন্নয়নের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট: পাওারিং দ্য ইকনমি ইফিসিয়েন্টলি’ শিরোনামে এই প্রতিবেদনে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত ক
রা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, জ্বালানির দক্ষতা বাড়ানোসহ উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে উচ্চ প্রবৃদ্ধির আকঙ্খা পুরণ করতে হলে বাংলাদেশকে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে আরও কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। সেইসাথে রফতানি বহুমূখীকরণ এবং মানবসম্পদ তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। বিশ্বের ১০টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এজন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। সংস্থাটি বলছে, অর্থনীতি যেই গতিতে চলছে তাতে চলতি অর্থবছর (২০১৮-১৯) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে, অবশ্য সরকারি হিসাবে এবছর ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, পরের অর্থবছর (২০১৯-২০) এটি আরো কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে যেতে পারে। অর্থনৈতিক সংস্কার করা হলে এই হার ৭ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান। মূল প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ঢাকা অফিসের প্রধান অর্ধনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এছাড়া প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন, পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এবং পিপিআরসির চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। ড. জাহিদ হোসেন উল্লেখ করেন, প্রবৃদ্ধি কতটা হচ্ছে সেই সংখ্যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রবৃদ্ধির সুফল কতটা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাছে। সংখ্যার চেয়ে অন্তর্ভূক্তি এবং উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর্থিক খাতের সুশাসন বাড়াতে হবে এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, বাংলাদেশের এখন দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষার উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে। দ্রুত পরিবর্তন হওয়া প্রযুক্তির সঙ্গে উপযোগী জনবল তৈরি করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান রফতানি বাজারের আকার কমে আসছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতকি সহায়তা সংকুচিত হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। জাহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য দেওয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে আসলে বাজেটের ওপর চাপ বাড়বে। তাছাড়া দেশে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের কারণে বাজেটে চাপ বাড়ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোর জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। আর্থিক খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার নির্ধারণসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে তদারকির ওপর জোর দেন তিনি। জ্বালানির বিষয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে আসছে। এর পরেও যেটুকু গ্যাস রয়েছে সেটিকে দক্ষভাবে উৎপাদন করলে ৮ দশমিক ১ শতাংশ ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১-১৭ সাল পর্যন্ত ৪৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এ সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ২০৩০ সালের বিদ্যুতের চাহিদা পুরণে এখন থেকেই উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষতা বাড়াতে হবে। অপচয় রোধ করতে হবে। তছাড়া বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার ভারতের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ এবং বিশ্ব গড়ের তুলনায় ১০ ভাগের একভাগ। উৎপাদনে দক্ষতা বড়ানো গেলে ১৫ দশমিক ২শতাংশ বাড়তি বিদ্যুতের ব্যবহার সম্ভব।
খেলাপি ঋণ দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. জাহিদ হোসেন উল্লেখ করেন, যে হারে খেলাপি ঋণ বাড়ছে তাতে বাজেটের ওপর চাপ বাড়ছে। গেলো অর্থবছর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এটা উদ্বেগের বিষয় যে দেশের সার্বিক খেলাপি ঋণের ৪৮ ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ছয়টি ব্যাংকে। বাকি ৪৪ ভাগ খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান অতিমূল্যায়িত উল্লেখ করে জহিদ হোসনে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত টাকা ৩৫ শতাংশ অতিমূল্যায়িত হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়েছে। যার ফলে রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন ঝুকির বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া সরকার রফতানিতে ভর্তূকি বাড়িয়েছে, এটা চ্যালেঞ্জ বাড়াবে। উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন না করার ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। মধ্য আয়ের দেশ হতে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সেটি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর রাখা এবং আর্থিক খাতে সংস্কার।
প্রতিবেদনে জ্বালানির দক্ষতা বাড়নোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ভর্তুকি কমিয়ে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের তাগিদ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎপাদনের মূল্য ভিত্তিক গ্যাস বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হলে বছরে ১৬৫ কোটি ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব।
তবে, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণ নির্ভরতা দেশের অর্থনীতির জন্য সংকট হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন আশঙ্কা করেছেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তাদের উভয়ের মতে, বড় আকারের বিদেশি ঋণ নির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ভবিষ্যতের ঋণ সংকট তৈরি হতে পারে। এজন্য মেগা প্রকল্পে সরকারি ব্যয়ের অংশ বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুফল কতটা পাওয়া যাবে সে বিষয়টিও দেখতে হবে। বড় আকারের ঋণ শ্রিলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো ‘ডেবট ট্রাপ’ বা ঋণের ফাঁদ যেন তৈরি না করে সে বিষয়ে সতর্ক করেন তারা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে বাংলাদেশের হালনাগাদ উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্যানেল আলোচনায় তারা এ কথা বলেন।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে গুণগত মান ও খরচ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এসব মেগা প্রকল্প থেকে কী ধরনের অর্থনৈতিক সুফল আসবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো হিসাব এখনও করা হয়নি। অথচ এসব মেগা প্রকল্পে যেভাবে ব্যয় বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকায় চলে যেতে পারে। মেগা প্রকল্পের প্রায় পুরোটাই ঋণ নির্ভর। এখানে সরকারের ব্যয়ের অংশ বাড়াতে হবে। আমাদের সামনে শ্রীলঙ্কার মতো উদাহরণ রয়েছে যারা অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণ নিয়ে ফাঁদে আটকে গেছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে করছি। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে যে ঋণ পাওয়ার কথা ছিলো সেটি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে খরচ করছি। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প বিদেশি ঋণে করছি। এধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যেন ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, শ্রিলঙ্কার শ্রীলঙ্কার মতো ‘ডেবট ট্রাপে’ না পরে যাই সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাংলাদেশের হালনাগাদ পূর্বাভাস প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং রপ্তানি ও রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা বজায় থাকলে চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হতে পারে। এদিকে সরকারি হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭দশমিক ৮ শতাংশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কিনা সে বিষয় ভেবে দেখতে হবে। কেননা বাংলাদেশে এখনো তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষ দরিদ্র্য। ৫৫ লাখ শিশু খর্বকায়। অপুষ্টি এখনও বড় সমস্যা। এদেশে এখন এমএ পাশ করা ছাত্র পিয়নের চাকরি করছে। তাহলে এই প্রবৃদ্ধি কার কাছে যাচ্ছে?। তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
এসএইচ/