২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা
বিএনপি সরকারের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
প্রকাশিত : ০৫:১৪ পিএম, ৯ অক্টোবর ২০১৮ মঙ্গলবার
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দিনটি ছিল শনিবার। ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয় সেদিন বিকেলে। স্বাভাবিকভাবেই সে হামলার বিস্তারিত খবর এবং সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য পরদিন অর্থাৎ ২২ শে আগস্ট পত্রিকার পাতায় মানুষের নজর ছিল।
সেদিন সবগুলো পত্রিকায় ব্যানার হেডলাইন অর্থাৎ আট কলাম জুড়ে ছিল গ্রেনেড হামলার খবর। এসব খবরের মূল বিষয় ছিল, ঘটনার বিবরণ এবং বিভিন্ন পক্ষের প্রতিক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই সে হামলার বিস্তারিত খবর এবং সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য পরদিন অর্থাৎ ২২ শে আগস্ট পত্রিকার পাতায় মানুষের নজর ছিল। সেদিন সবগুলো পত্রিকায় ব্যানার হেডলাইন অর্থাৎ আট কলাম জুড়ে ছিল গ্রেনেড হামলার খবর।
এসব খবরের মূল বিষয় ছিল, ঘটনার বিবরণ এবং বিভিন্ন পক্ষের প্রতিক্রিয়া। শুধু ২২শে আগস্ট নয়, এর পর অন্তত পাঁচদিন সবগুলো খবরের কাগজে গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত নানা খবরা-খবর এসেছিল। গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি তৎকালীন বিএনপি সরকারের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি করেছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়।
ঘটনার পর দিন ২২ শে আগস্ট সচিবালয়ে সবার মধ্যেই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল গ্রেনেড হামলার খবর। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সরকারের উৎকণ্ঠা। একই সাথে ক্ষোভ এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে।" গ্রেনেড হামলা যেদিন হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায় বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বিবিসি বাংলাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন।
তাঁর এ সাক্ষাৎকারটি পরদিন সবগুলো খবরের কাগজে বিবিসি বাংলার বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয়। গ্রেনেড হামলার পর সেটি ছিল গণমাধ্যমের সাথে শেখ হাসিনার প্রথম সাক্ষাৎকার। সে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের মদদে গ্রেনেড হামলা হয়েছে।
হামলার পর দেশজুড়ে আওয়ামীলীগ সমর্থকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। হামলায় নিহতদের মধ্যে আইভি রহমান অন্যতম। হামলার দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতির মাধ্যমে হামলার নিন্দা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি হামলায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন।
কিন্তু আওয়ামীলীগ কর্মীদের বাধায় সেটি সুধা সদনে দেয়া যায়নি। কারণ, এ হামলার জন্য বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে সরকারকে দোষারোপ করেছেন।
তৎকালীন বিএনপি সরকারের চিন্তাধারা হামলার কয়েকদিন পরেই তৎকালীন সরকারের দিক থেকে বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসার আগ্রহ দেখানো হয়।
২৬ শে আগস্ট ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর নেতাদের সাথে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, তিনি সংলাপে আগ্রহী। এজন্য তিনি সকল পক্ষের সহযোগিতা কামনা করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সেটি নাকচ করে দেয়া হয়।
একই দিন সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলো লিখেছে," খুনির সাথে কিসের সমঝোতা? যে আমাদের খুন করতে চেয়েছে তার সঙ্গে কোন সমঝোতা নয়। বিএনপি সরকারের দিক থেকে সংলাপের আগ্রহ দেখানো হলেও একই সাথে বিরোধীদের রাজপথে মোকাবেলার প্রস্তুতিও নিতে থাকে তারা। কারণ ঘটনার পর আওয়ামী লীগের তরফ থেকে হরতাল এবং প্রতিবাদ কর্মসূচী দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন বিএনপি তরফ থেকে ৩০শে আগস্ট প্রতিবাদ কর্মসূচীর ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচীর মাধ্যমে বিএনপি দেখাতে চেয়েছিল যে তারা মাঠ ছেড়ে যায়নি।
বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসার আগ্রহ মানে সরকারের দূর্বলতা নয়।
মি: ভুঁইয়া বলেন, " বিরোধী দল ইচ্ছাকৃত-ভাবে একের পর এক হরতাল দিয়ে পায়ে পা রেখে ঝগড়া করার চেষ্টা করছে। আমাদের কর্মসূচী চলবে। এতে সংঘাত সৃষ্টি হলে বিরোধী দল দায়ী থাকবে।"
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বিএনপি সরকার। গ্রেনেড হামলার কয়েকদিন পরেই পাঁচ বাহিনীর প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। দৈনিক ইত্তেফাক-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী অরাজক পরিস্থিতির আশংকায় সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশের দিক থেকে তদন্ত শুরুর পাশাপাশি ইন্টারপোল-এর কাছ থেকে সহায়তার কথা জানিয়েছিল সরকার। যদিও বিরোধী দল আওয়ামীলীগের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার বলেছিল ইন্টারপোল ছাড়া অন্য কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নেবে না সরকার।
গ্রেনেড হামলার একদিন পর সাংবাদিকদের সামনে শেখ হাসিনা। উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা ভর করেছিল তাঁর মনে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের `সঠিক তথ্য` দানকারীকে এক কোটি টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে। ২৯শে আগস্ট সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মাসিক সভায় গ্রেনেড হামলার তদন্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা শেষে এ পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জমান বাবর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকাকে বলেন, " গণতন্ত্র আজ হুমকির মুখে। এই মুহূর্তে দেশ ও জাতীর স্বার্থে এক কোটি টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তদন্তের জন্য সরকারের দিক থেকে নানা কথা বলা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। সে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য বিএনপি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা ছিল সেটি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
হামলার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকার চিত্র। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি এ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। এছাড়া সরকারের তরফ থেকে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। যদিও সে কমিশনে কোন আস্থা ছিল না বিরোধী দল আওয়ামী লীগের। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান ২৬শে আগস্ট সাংবাদিকদের বলেন, হামলার পেছনে গোপন সংগঠন, ধর্মীয় উগ্রবাদী, অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক শক্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে আওয়ামীলীগ ও রাজনৈতিক মিত্রদের ডাকা হরতালের সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গ্রেফতার করে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর বিপরীতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপিও কর্মসূচীর ডাক দেয়। গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে। ২৪শে আগস্ট জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান আওয়ামীলীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিন্দা জানান। গ্রেনেড হামলার পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন।
তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তিনি অবাক হয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা হামলার ঘটনায় সুষ্ঠু এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্তের করার আহবান জানিয়েছে সরকারের প্রতি। রাষ্ট্রদূতদের এ ধরণের আহবান থেকে বোঝা যায়, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত নিয়ে তাদের মনে এক ধরণের আশংকা ছিল। ২৭ শে আগস্ট দৈনিক যুগান্তর এক প্রতিবেদনে জানায়, শেখ হাসিনার সাথে ১৯ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
শুধু বিদেশীরা নয়, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের যারা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তাদের সবাই দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর সাংবাদিক আতাউস সামাদ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় যে বিশ্লেষণ লিখেছেন সেটির শিরোনাম ছিল, "এরপর আর বাকি থাকল কী?" তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল গ্রেনেড হামলার কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেন। মি: পাওয়েল সে টেলিফোন আলাপে জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনে বলেন, সব দলের একসাথে কাজ করা উচিত।
টিআর/