ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

একুশ আগস্ট

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত সন্ত্রাসের যথার্থ বিচার

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ০৫:৪৬ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৫১ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৮ মঙ্গলবার

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সংঘটিত গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনা নিয়ে তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের প্রহসনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ এখন সম্যকভাবে পরিচিত। সেই বীভৎস হত্যাযজ্ঞের মামলার রায় গতকাল ঢাকার বিশেষ আদালত ঘোষণা করেছেন। রায়ে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের ফাঁসি হয়েছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বর্তমানে পলাতক তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডের তালিকায় আছেন বিএনপির আরো কয়েকজন প্রতাবশালী নেতাসহ সে সময়ের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আদালত ১২টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তাতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছে, যারা শপথ নিয়ে রাষ্ট্রের রক্ষকের আসনে বসেছিল তারাই রাষ্ট্রকে হত্যা করার জন্য ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাটি চালিয়েছিল। আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দুই সামরিক শাসক এবং তাদের নতুন প্রতিভূদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাংলাদেশের পরিবর্তে ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানি স্টাইলের আরেকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ নামের খোলসে এখানে প্রতিষ্ঠিত করা।

জিয়াউর রহমান কর্তৃক জামায়াতসহ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পুনরুত্থান, বাহাত্তরের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সব শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাতিল, রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা সব মুছে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিচার করা যাবে না এই মর্মে আইন করাসহ এরশাদ কর্তৃক সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের সংযোজন এবং খালেদা জিয়া যখন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানান, তখন এঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ থাকে না।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত এঁদের সবারই ধারণা ছিল, দেশের মানুষকে ধর্মান্ধতার বড়ি গিলিয়ে এবং ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে তাঁরা চিরদিন ক্ষমতার মধু পান করতে পারবেন। কিন্তু কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তাঁরা বুঝতে ভুল করেছেন ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতির একটা অদৃশ্য সহজাত শক্তি আছে, যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকা অসম্ভব। এই অমোঘ সত্যকে তাঁরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।

বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা যেভাবে দেশে ফিরলেন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হলেন, এটা ছিল ওই ধর্মাশ্রয়ী মধু ভক্ষণকারীদের ধারণার বাইরে। তাঁরা ভেবেছিলেন জীবনের ভয়ে শেখ মুজিবের দুই এতিম মেয়ে আর কোনো দিন দেশে ফিরবেন না। ফাঁকা মাঠে চিরকাল মধু খাবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর যত দ্রুতগতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী উদার প্রগতিশীল মানুষ এবং তরুণ প্রজন্ম যখন জেগে উঠতে শুরু করল, তখন ওই সম্মিলিত অপশক্তি প্রমাদ গুনতে নেমে পড়ল।

তারা বুঝতে পারল শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মুখ থুবড়ে পড়বে এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে নিঃশেষ করার অপকর্মে যারা দায়ী তাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না। তাই ওই অপশক্তির প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আবার কখনো সম্মিলিতভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ কারণেই দেখা যায়, গত ৩৭ বছরে শেখ হাসিনার ওপর ১৯ বার হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে অন্যান্য দলের টপ নেতৃত্বের কারো গায়ে একটি টোকাও পড়েনি।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় চলে এলে তাদের হিসাব-কিতাব আরো এলোমেলো হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে তাঁকে সহজে হত্যা করা যাবে না। বহুবিধ পন্থা ও কৌশলের অংশ হিসেবে তারা ধর্মান্ধ উগ্রবাদী জঙ্গিদের উসকে দেয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার ফলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার পুনর্জাগরণ ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করার ভেতর দিয়ে ওই অপশক্তি নিশ্চিত হয়ে যায়, শেখ হাসিনা জীবিত থাকলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পূর্ণ বাংলাদেশের পুনরুত্থান তারা কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

শুধু তা-ই নয়, তারা আরো বুঝতে পারে, শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় এলে একাত্তরে যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তারা কেউ রেহাই পাবে না। প্রতিবেশী দেশের আরেকটি বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শেখ হাসিনার উত্থানে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এরা হলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী, যাদের পৃষ্ঠপোষক আবার বাংলাদেশের পুরনো শত্রু পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।

আইএসআই ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কাশ্মীরি জঙ্গি ইউসুফ ওরফে মাজেদ ভাটের এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পঁচাত্তরের ঘটনার জের ধরে যারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী হয়েছে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ নয়, বরং ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানি স্টাইলের দেশ চায়, তারা সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। শেখ হাসিনাকে চিরতরে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রসহ বহুবিধ পন্থার অংশ হিসেবে সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনকে ব্যবহারের পথ বেছে নেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এই গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে কৌশল ও লক্ষ্য ছিল পঁচাত্তরের মতো। আওয়ামী লীগের সব সিনিয়র নেতাই ছিলেন এক মঞ্চে। সেদিন আক্রমণকারীদের মিশন সফল হলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আর কেউ অবশিষ্ট থাকতেন না।

দীর্ঘ অনুসন্ধান ও শুনানির পর আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা ও আগ্রহের জন্য মিডিয়ায় অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়, যার দু-একটি এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, হাওয়া ভবনের পরিকল্পনায় ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, বাবর গ্রেনেড সরবরাহ করেন এবং ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করে হরকাতুল জিহাদ।

দ্বিতীয়ত, ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিদের আক্রমণের জন্য সহায়তা করে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার একাংশ। জিজ্ঞাসাবাদে তিনজনের স্বীকারোক্তি, আর্জেস গ্রেনেড আসে পাকিস্তান থেকে। তৃতীয়ত, ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার পর বঙ্গবন্ধুর খুনি রশীদ-ডালিমের ফোন বাবরের কাছে—হাসিনা বাঁচল কী করে? বিএনপি এখন যা-ই বলুক না কেন, কিছু ভাইটাল প্রশ্নের উত্তর তো তাদের থেকে এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রথম প্রশ্ন—তারা প্রহসনের জজ মিয়া নাটক সাজালেন কেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন—অবিস্ফোরিত গ্রেনেডসহ ঘটনার সব আলামত নষ্ট এবং ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলা হলো কেন? তৃতীয়ত, পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড বাংলাদেশে এলো কী করে? পিওএফ (পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি) চিহ্নিত গ্রেনেড পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কারো হাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রশিক্ষণ ছাড়া গ্রেনেড নিক্ষেপ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে আক্রমণকারীরা কোথায়, কিভাবে এই প্রশিক্ষণ নিল।

বিএনপি যেহেতু তখন ক্ষমতায় ছিল, এসব প্রশ্নের উত্তর তো তাদেরই দিতে হবে। সে সময়ের জামায়াত-বিএনপি সরকার প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য কিভাবে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিল তার কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রধান দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মিথ্যা অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার পর ওই পত্রিকায় প্রতিবেদকের কাছে সেই করুণ ও নির্মম কাহিনির বর্ণনা দেন আলোচিত নোয়াখালীর দিনমজুর জজ মিয়া।

২১ দিনের রিমান্ডসহ ২৭ দিন ঢাকার সিআইডির কার্যালয়ে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয়, আবার প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের জন্য প্রস্তুত করা হয় জজ মিয়াকে। জবানবন্দি দেওয়ার অভিজ্ঞতা প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে জজ মিয়া বলেন, হাত-মুখ ধুয়ে আবার ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় আসি।

আসার পর ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, জজ মিয়া, তুমি এখানে সই করো। আমি বলি, স্যার, আমার কোনো অসুবিধা হবে না তো? ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, তুমি রাজসাক্ষী হবে। পরে তোমাকে ওনারা (সিআইডি কর্মকর্তাদের দেখিয়ে) ছাড়িয়ে নেবেন। যদি সই না দাও, তাহলে তুমি আসামি হবে, তোমার ফাঁসি হবে। আমি সই করে দিই। এরপর ওই রুমে বিরিয়ানির প্যাকেট আনা হয়। আমি, ম্যাজিস্ট্রেট, মুন্সি আতিক, আবদুর রশীদ একসঙ্গে বিরিয়ানি খাই।

এত বড় একটা বীভৎস হত্যাকাণ্ড নিয়ে যাঁরা এ রকম মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর তামাশা করলেন, তাঁদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত অমোঘ নিয়মেই হয়। সেটাই আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সব সাজানো নাটক ও ষড়যন্ত্র তছনছ হয়ে যায়। অভিযুক্ত জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে তা মানুষের কাছে আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।

২১ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সব দুর্বৃত্তায়নকে ছাড়িয়ে গেছে। সব ধরনের মানবিক ক্ষমা ও অনুকম্পার অযোগ্য অপরাধ যাঁরা করেছেন তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রকে নিষ্ঠুর হতে হবে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং এ রকম নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে।

‘লুকিং ফর শত্রুজ’ নাটকের গুরু লুৎফুজ্জামান বাবর এখন নিজেই আসল শত্রু প্রমাণিত হয়ে বাংলাদেশের আইন ও আদালতের খাঁচায় আবদ্ধ হলেন ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনার যথার্থ বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরেকটি কলঙ্ক থেকে মুক্ত হলো।

লেখক : কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com