ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

স্মৃতিতে আজও অমলিন দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান 

কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক

প্রকাশিত : ১১:৫৭ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১১:০৮ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০১৮ রবিবার

মুস্তাফিজুর রহমান 

মুস্তাফিজুর রহমান 

সন্দ্বীপের মাটি ও মানুষের পরম আপনজন দ্বীপবন্ধু মোস্তাফিজুর রহমানের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০১ সালের ২০ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন সন্দ্বীপ তার প্রিয় সন্তানটিকে হারিয়েছিল।

দ্বীপবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা সত্যি কষ্টের। তোমার সঙ্গে স্মৃতিগুলো মনের আকাশে উঁকি দিচ্ছে বারংবার। ছোটবেলায় দাদু আমাকে সব অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। ১৯৯৭ সালের কথা তখন চারদিকে দ্বীপবন্ধুর অনেক নাম ডাক। বাড়ির সামনে দিয়ে দ্বীপবন্ধুর জলপাই রঙের জিপ গাড়িটি গেলে আমরা দৌড় দিতাম তাকে এক নজর দেখতে। ভীরের মধ্যে তাকে অনেকবার দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই মন ভরতো না। ছোট্ট এই আমি দ্বীপবন্ধুর সাক্ষাৎ পেতে মনটা ভীষণ অস্থিরতায় ভুগতো।

অবশেষে স্বপ্ন পূরণের পালা এলো। কিছুদিন পর সন্দ্বীপ পাবলিক হাই স্কুলের মাঠে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। দাদু আমাকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে। সেখানেও গিয়েও দাদুকে বারবার প্রশ্ন করছিলাম দাদু মোস্তাফিজ কোথায়? বিকেলে মুস্তাফিজুর রহমানের গাড়ি স্কুলে পৌঁছালে হাজারো জনতা তাকে অভিবাদন জানায়। তিনি ধীরে ধীরে মঞ্চে এলেন।

সেই শীতের সন্ধ্যায় মঞ্চে আমি ছিলাম দাদুর কোলে। আমার সঙ্গে দ্বীপবন্ধুর পরিচয় করিয়ে দিলেন দাদু। আমাকে তার কোলে তুলে নিলেন। আমাকে আদর দিয়েছেন ,ভালোবেসে বুকে টেনে নিয়েছেন। আমার নাম জানতে চাইলেন? তারপর আমার গেঞ্জিতে কি লিখা আছে তা পড়তে বললেন। বুকে লেখা ছিল congratulation… বাংলায় এর অর্থ কী জানতে চাইলেন? উওরে বললাম,অভিনন্দন। তিনি আমাকে বললেন তোমাকে অভিনন্দন। তারপর স্বভাব সুলভ হাসি।

আমার মুখে তখন এত বড় শব্দ শুনে কিছুটা অবাক হয়েছেন? আমাকে তিনি বললেন তোমাকে এই শব্দের অর্থ কে শিখিয়েছেন? আঙ্গুল দিয়ে দাদুকে দেখিয়ে দিলাম। দ্বীপবন্ধুর পাশের চেয়ারে বসে থাকা দাদুকে বললেন, কাজী সাহেব আপনার নাতি সঠিক অর্থ বলতে পেরেছে। তার কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে মাল্যদান করা হয় দ্বীপবন্ধুকে। একই মঞ্চে থাকা দাদুর গলায় মালা পরিয়ে দেন দ্বীপবন্ধু। হঠাৎ করে দ্বীপবন্ধু আমাকে কোলে নিয়ে টেবিলে দাঁড় করিয়ে দেন। তার নিজের গলার মালাটা আমাকে পড়িয়ে দিলেন। আর তখন উৎসুক জনগণের মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দিত করছিলো। সেই করতালির শব্দ এখনো কানে বাজে। সেই ছোঁয়া এখনো হৃদয়ে শিহরণ জাগায়।

এরপর দাদু আমাকে কোলে নিতে চাইলে তিনি দিলেন না। বললেন থাক না আমার কোলে, ছোট মানুষ। ওর ঠাণ্ডা লাগছে। দ্বীপবন্ধুর তার গায়ের শাল দিয়ে আমার হাত পা মুড়ে দিলেন। দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে তিনি আমাকে কমলার কোষ আর বাদাম খাইয়ে দিলেন। দ্বীপবন্ধুর এই অকৃপণ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রথম পরিচয় ঘটে তার হৃদয়ের বিশালতার সঙ্গে। শিশু সুলভ দ্বীপবন্ধু চমকে দিলেন আমাকে।

ওনার সাদা শাল দিয়ে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। যত খানি তিনি জড়ালেন, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসার একটি আকাশের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটলো। আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান যে, দ্বীপবন্ধুর ভালোবাসা আমি পেয়েছি। আসলেই মহৎ হৃদয়বান মানুষগুলো বোধ হয় এমনই হয়।

সেই কবেই শৈশবের স্মৃতিতে তুমি মিশে আছো। আজও আছ, পরম আপন হয়ে। সেই অনুষ্ঠানের পরদিন আমার এলাকায় অনেকে জানতে চেয়েছে মুস্তাফিজ সাব তোমাকে কি বলেছে? কি দিয়েছে? কথাটা আজও মনে পড়লে হাসি আসে। তিনি যা দিয়েছেন তা তো আজ মনে রেখেছি। আমার মরণ অবধি এই স্মৃতি আমাকে পরম আনন্দ দিবে, শক্তি দিবে।

আমি ভাগ্যবান, আমি এক পরম ভালো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপরে অনেক বার তাকে দেখেছি, সে সব দিনের স্মৃতি আজও অমলিন। বাড়ির সামনে দিয়ে তোমার জলপাই রঙের জিপটি গেলে, মনে হতো এই তো তুমি?

মরণে অমরতা সবাই পাই না, তুমি পেয়েছ তোমার কর্মের গুণে।

কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র মৃত্যুকে নিয়ে লিখেছেন –‘যে তারা জাগিয়া থাকে তারে লয়ে, জীবনের খেলা ভুবনের মেলা/যে তারা হারালো দ্যুতি/যে পাখি ভুলিয়া গেল গান/এ ভুবনে কোথা তার স্থান?

তোমার স্থান গণমানুষের হৃদয়ে, আমার হৃদয়ে, হাজার হৃদয়ে, লাখ ও মানুষের মনোমন্দিরে। তোমার নাম লিখা হয়ে গেছে সন্দ্বীপের ইতিহাসের সোনালী পাতায়। তুমি ঘুমাও, পরম মমতায় এই দ্বীপ তোমাকে ধরে রাখবে, মানুষ মনে রাখবে।

এসএইচ/