বিবিসির বিশ্লেষণ
কতটা বিরোধী দল হতে পেরেছে জাতীয় পার্টি?
প্রকাশিত : ০৩:২১ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০১৮ বুধবার
দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন চলছে। এই সংসদে একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে ছিলো জাতীয় পার্টি। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে যেটি নজীরবিহীন এক ঘটনা। এমন অবস্থায় গত সংসদে বিরোধী দল হিসেবে কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় পার্টি কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে?
গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বেশ বড় আকারের একটি জনসমাবেশ করে জাতীয় পার্টি। সমাবেশে দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ঘোষণা করেন, আগামী নির্বাচনে তার দল এককভাবে তিনশো আসনে প্রার্থী দিয়ে অংশ নেবে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার আকাঙ্খার কথাও প্রকাশ করেছেন এরশাদ।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এখন যে সরকার দেশ চালাচ্ছে সেখানে এরশাদের জাতীয় পার্টিও অংশীদার। কিন্তু সরকারের অংশীদার হয়ে সরকারে কিংবা বিরোধী দলে থেকে দলটির ভূমিকা নিয়ে রয়েছে নানান সমালোচনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা মনে করেন, বিরোধী দল হিসেবে গত পাঁচ বছরে জাতীয় ইতিবাচক কোনও কিছু করে দেখাতে পারেনি।
সংসদে তাদের তেমন কোনও ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি, সংসদের বাইরেও দেখতে পাইনি। তারা বিভিন্ন ইস্যুতে বরং সরকারের প্রতিধ্বনিই করেছে। আমার কাছে তো মনে হয়নি যে, সংসদে যে বিরোধী দল গত পাঁচ বছরে ছিলো তারা সরকারকে নতুন কোনোকিছু ভাবাতে পেরেছে কিংবা জনগনকে।
একইরকম মূল্যায়ন বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির গবেষণায়ও উঠে এসেছে।
চলতি সংসদের প্রথম থেকে ১৮তম অধিবেশন নিয়ে সংস্থাটির যে মূল্যায়ন প্রতিবেদন সেখানে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকাকে বলা হয়েছে অকার্যকর। কিন্তু এরকম মূল্যায়নের কারণ কী?
টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলছিলেন, তারা নিজেরাই কিন্তু বিভিন্ন সময় বলেছেন যে, আমরা বিরোধী দল না; আমরা কী সেটা আমরা নিজেরাই বুঝতেই পারি না। কারণ দলটির কেউ কেউ আবার মন্ত্রিপরিষদেও আছেন। তো তাদের স্বার্থ তো সেখানে একাকার হয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছে না যে, তারা সরকারের সঙ্গে সরকারের নীতি মেনে চলবে নাকি বিরোধী দল হিসেবে সংসদে জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরবে। সুলতানা কামালের মতে, জাতীয় পার্টি কোনও ইস্যুতেই জনগনের স্বার্থকে সংসদে তুলে ধরতে পারেনি।
২০১৮ সালে প্রকাশ হওয়া টিআইবির প্রতিবেদনে আরও দেখা যাচ্ছে, সংসদের প্রথম থেকে ১৮তম অধিবেশন আইন প্রণীত হয়েছে ১২২টি। সেগুলোতে বিরোধী দলের ভূমিকা নেই বললেই চলে।
সংসদে আইন পাসের জন্য বিলগুলো এনেছিলো মূলত: সরকারি দল। তবে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে আলোচনায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু সেটাও খুব একটা সুফল বয়ে আনেনি।
এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বিল পাসের আগে আলোচনায় দলটির সংসদ সদস্যরা নানা আপত্তি উত্থাপন করলেও বিভক্তি ভোটের সময় নিজেদের আপত্তি ভুলে গিয়ে সরকারি দলের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন।
এছাড়া সংসদে ৭৫ শতাংশের বেশি কার্যদিবসে উপস্থিত থেকে সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন জাতীয় পার্টির এমন সদস্যের সংখ্যাও কম। মাত্র ৩৪ দশমিক ০৫ শতাংশ।
এমনকি বিরোধী দলীয় নেতারও সংসদে উপস্থিতির ক্ষেত্রে অনীহা দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি যেখানে সংসদের মোট কার্যদিবসের ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ সেখানে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের উপস্থিতি ৫৬ শতাংশ।
তারা সংসদে যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত থাকছেন না। এবং সেখানে তাদের যে ভূমিকা, তারা হয়তো কোনও কোনও বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আপত্তি তুলেছেন কিন্তু সরকারি দল থেকে যখন চাপের মুখে পড়ছেন তখন সরকারি দল যা বলছে তাতেই কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। আগে তো অনেক বিরোধীতা হতো, বয়কট হতো, ওয়াকআউট হতো। তারা তো এসবে যাননি। এমনকি তারা কখনও জোরালোভাবে একথাটিও বলেননি যে, আমরা যে সব দ্বিমত পোষণ করছি সেটা রেকর্ডেড হোক। বলছিলেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল।
কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে যে সব সমালোচনা, সে সবের সঙ্গে অবশ্য পুরোপরি একমত নয় জাতীয় পার্টি। দলটির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলছিলেন, গত নির্বাচনটা স্বাভাবিক পরিস্থিতে হয়নি। একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতেই জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয়েছিল। এবং সংসদে আমাদের সদস্য সংখ্যা যদি দেখেন, সেটা সরকারি দলের তুলনায় একেবারে নগণ্য। কাজেই আমরা ছায়া মন্ত্রিসভা করে তাদের সব কাজের সমানতালে মোকাবেলা করবো, এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য ছিলো না। তথাপি সরকারের অনেক কাজের সমালোচনাই আমরা করেছি। কিন্তু আমাদের সংসদীয় ইতিহাসে বিরোধী দলের সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা নেই বললেই চলে। আমাদের ক্ষেত্রেও হয়নি।
কাদের খুব স্পষ্টভাবেই বলছেন, সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের অনেক আপত্তিই গ্রাহ্য করা হয়নি।
এখানে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে তার ভূমিকা নিয়ে যে পরিস্থিতির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সাদা চোখে এর পেছনে হয়তো দলটির দুর্বলতাই মূল কারণ বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে জাতীয় পার্টি বা তার শক্তিমত্তা নয় বরং দেশে কার্যকর গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকাকেই দায়ী করতে চান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা।
তিনি বলছিলেন, এখন গণতন্ত্রের একটা আনুষ্ঠানিকতা পালন হচ্ছে, একটা রিচুয়্যাল পালন হচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য সবা পক্ষকে কথা বলতে দিতে হবে। সব বিরোধীতা শোনার এবং প্রয়োজন হলে সে অনুযায়ী পরিবর্তনের সুযোগ থাকতে হবে। সেগুলো তো এখানে ছিলো না।
বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে বিরোধী দলের কার্যকর ভূমিকা আর কার্যকর গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সেটা নিশ্চিত হতে পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। আর দেশে এখন সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্র: বিবিসি
একে//