ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

শয়তানের সঙ্গে ঐক্য!

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত : ১১:১৬ এএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১২:০৯ এএম, ৩ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের শাসন আমলে তখনকার সময় দুর্বৃত্তদের নির্মম ছুরির আঘাতে নিহত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ময়মনসিংহের মেডিক্যাল কলেজ শাখার সেই সময়কার যুগ্ম সম্পাদক রাইসুল ইসালম নোমান।

অনেকের মতো শহীদ নোমান বিচার পাননি। বিচার পাননি নোমান ভাইয়ের পরিবারও। বহু বছরের বিস্মৃতিতে শহীদ রাইসুল হাসান নোমান এখন প্রায় বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম।

প্রিয় বন্ধু, একসময়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি, এখন অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ডা. একরাম শুধু মনে করে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর নোমান ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে যত্ন করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয়, আর আমরা দুই চার-পাঁচজন তাতে লাইক আর কমেন্ট দিয়ে দায়িত্ব সারি। ব্যস এটুকুই।

পঁচাত্তরের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে যেদেশে জাতির জনক আর তার পরিবারের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের বদলে বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে, বিচারহীনতার সেই বাংলাদেশে সামান্য একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্টের পরিবার তার হত্যাকাণ্ডের বিচার পাবেন—এমনটা যেন প্রত্যাশিত নয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের শাসনকাল প্রায় শেষ হতে চলল। সামনে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃতীয় মেয়াদে তার অর্জন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

বাংলা ডিকশনারিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক নতুন শব্দের জন্ম দিয়েছেন—ডিজিটাল বাংলাদেশ, এলএনজি টার্মিনাল, পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র, স্যাটেলাইট, বুলেট ট্রেন, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ওয়াইব্রিজ, এমনি আরো কত কি! তার নেতৃত্বের অনন্যতায় বাংলাদেশ আজ কত কিছুতেই তো বিশ্বের রোলমডেল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শাসন আমলেই বিচার হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের। বিচার হয়েছে প্রচলিত আদালতে, প্রচলিত আইন মেনেই। দীর্ঘ, ক্লান্তিকর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আংশিক কার্যকর হয়েছে সেই রায়।

কিন্তু জাতির দায়মুক্তি হয়েছে পুরোটাই আর সংবিধান হয়েছে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভারমুক্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছেন, ব্যাপারটি এভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রী জাতিকে জাতির পিতার হত্যার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এবং এখনও চলমান। এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে শীর্ষ অপরাধীদের অনেক দণ্ডই। বিচার যেমন পেয়েছেন অনেকেই, তেমনি বিচার পাবেনও না অনেকেই। লাখ-লাখ শহীদের শত-সহস্র হত্যাকারীর সবার বিচার হবে না, সেটাও বাস্তবতা। যেমন কোনোদিনও বিচার হবে না আমার প্রয়াত শ্বশুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডেরও।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার চিহ্নিত খুনী মাওলানা মান্নানের। সৌভাগ্য মান্নানের, দুর্ভাগ্য শহীদ আলীম চৌধুরীর পরিবারের। তবে সন্তুষ্টি তো আছে। তারা জানেন এদেশে এখন বিচার হয়। মাওলানা মান্নান আজ বেঁচে থাকলে বিচার হতো তারও।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদেশকে দিয়েছেন অনেক, দিবেনও অনেক—এই বিশ্বাস আছে। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দিয়ে তিনি এদেশকে যা দিয়ে গেলেন, তার সুফল এ জাতি ভোগ করবে আরো শত-সহস্র বছর।

বিচারহীনতা কাকে বলে? বিচারহীনতা হলো সেই ক্ষমতা যা একজন যুদ্ধাপরাধীকে সাহস জোগায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে একজন শহীদ জায়াকে তাকে স্বাগত জানানোর নির্দেশ দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা দেখানোর, যেই শহীদের হত্যাকারী সে নিজে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মতই তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জটাও অনেক বড়। আমাদের চারপাশে এই যে এত-শত অপশক্তি—এদের সবার ক্ষমতার উত্সইতো এই বিচারহীনতা। তাদের সর্বাত্মক প্রয়াস থাকবে সময়ের কাঁটাকে পিছনে ঘুরিয়ে দিতে। ঐক্যও হবে তাই ‘শয়তানের’ সঙ্গে।

মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এই ঐক্য শুধু একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। এর লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। সাম্প্রতিকতম যে রায়টি আজ পত্রিকার শিরোনাম, এটি তাদের জন্য অশনিসংকেত। কারণ এটিই সম্ভবত এদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কফিনে সর্বশেষ পেরেক।

শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন এদেশে এখন আর কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, তা সে আপনি যে-ই হন, যতই বিস্তৃত হোক আপনার হাত আর যতই সংগঠিত হোক আপনার অপরাধ। এই বাংলায় একদিন না একদিন আপনার বিচার হবেই। নিস্তার নেই।

এসব বিষয় আপনি যত ভালো বোঝেন তারচেয়েও বেশি বোঝে বিচারহীনতার বেনিফিশিয়ারিরা। যারা চিহ্নিত তারাতো আছেই, এখন তাই প্রকাশ্যে আসছে এতদিন আমাদের আশেপাশেই ঘাপটি মেরে থাকা বর্ণচোরারাও।

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরপরই যাদের আমরা দেখেছি তত্কালীন বিরোধী দলের দায়িত্বশীল পদে থেকে জনসভায় গরম বক্তৃতা দিতে কিংবা নেতৃত্ব দিতে আইনজীবীদের প্রতিবাদী মিছিলে, তারাই আজ তাই বিপরীত শিবিরে। এদের কেউ কেউ সংবিধানের প্রণেতাদের একজন তো কেউ আবার স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা। তাদের সাথে সামিল হয়েছেন বিভ্রান্ত একদল সুশীলও।

এরা জানে যে হয় এইবার নয়তো কখনোই না। সেই বাংলাদেশ থেকে এই বাংলাদেশের এই যে উত্তরণ এবং তারও বেশি কিছুর যে প্রবল সম্ভাবনা, তাকে এরা টুঁটি টিপে মারতে চায় দু’হাতে।

এখন সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে, আমাকে, আমাদেরকে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি শহীদ নোমানের রেখে যাওয়া বাংলাদেশ চাই? নাকি সেই বাংলাদেশ চাই, যেখানে পরীক্ষার হলে নোমানদের শরীরে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়ার আগে হন্তারকের হাত কাঁপবে শতবার?

আর যদি দ্বিতীয়টি আপনার চাহিদা হয়, তবে আসুন সবাই, সব ভুলে সিদ্ধান্ত নিই—এই বাংলাদেশকে আমরা আর পেছনে হাঁটতে দেব না। এবারের লড়াই আমাদের-ওদের চূড়ান্ত লড়াই। যিনি নিজের ঊর্ধ্বে উঠে পরিণত হয়েছেন ‘বাংলাদেশের মায়ের’। আসুন, বছর শেষে আমরা সবাই তার ঢোল-ই বাজাই।

লেখক : চেয়ারম্যান, হেপাটলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

/ এআর /