ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধা

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত : ১১:২০ এএম, ৩ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৭:০৮ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার

প্রতি বছর যখন জাতীয় জীবনে ৩ নভেম্বর ফিরে আসে, তখন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানের আত্মত্যাগের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে পড়ে।

`৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁরা বারবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যেদিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি। ভয়ঙ্কর-বিভীষিকাময় দুঃসহ জীবন তখন আমাদের!

ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার ছিলেন নির্মলেন্দু রায়। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, `ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মিস্টার ফারুক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।`

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত রাতে কেন? তিনি বললেন, `ঢাকা কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।` আমি বললাম, না, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাকে যদি হত্যাও করা হয়, আমি এখান থেকে এভাবে যাব না। পরবর্তীকালে শুনেছি, সেনাবাহিনীর একজন মেজর সেই জেলখানার সামনে এসে কারাগারে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু নির্মলেন্দু রায় বলেছিলেন, `আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে কারাগারে প্রবেশ করতে দেব না।` কারাগারের চারপাশে সেদিন যারা আমাকে রক্ষার জন্য ডিউটি করছিলেন, তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে আমার সহপাঠী ওদুদ, আমরা একসঙ্গে এমএসসি পাস করেছি এবং দেশ স্বাধীনের পর `৭৩-এ যিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারাগারকে রক্ষা করার জন্য। আমি নির্মলেন্দু রায় এবং ওদুদের কাছে ঋণী।

২২ আগস্ট জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের অনেক বরেণ্য নেতাকে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল হত্যা করার জন্য। যে কোনো কারণেই হোক ঘাতকের দল শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। পরে নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

গৃহবন্দি অবস্থা থেকে একদিনে আমাকে, জিল্লুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাককে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ৬ দিন বন্দি রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। স্মৃতির পাতায় তার কত কিছুই আজ ভেসে ওঠে। দল পুনরুজ্জীবনের পর `৬৪তে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সাধারণ সম্পাদক এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। `৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাই যোগদান করেন।

বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেওয়ার পর ১৮, ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম সহসভাপতি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অন্যতম সহসভাপতি এবং এএইচএম কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

বঙ্গবন্ধু যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসাতেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।

১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামারুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আমিও মাত্র ২৭ বছর বয়সে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলাম।

১৯৭১-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজউদ্দীন আহমদ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এবং কামারুজ্জামান সচিব, চিফ হুইপ পদে ইউসুফ আলী এবং হুইপ পদে যথাক্রমে আবদুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নির্বাচিত হন।

আর প্রাদেশিক পরিষদে নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মনসুর আলী হবেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এ জন্য মনসুর আলীকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সেটআপ করা ছিল। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সর্বাত্মক স্বাধীনতা ঘোষণার পর শুরু হয় অসহযোগের দ্বিতীয় পর্ব। বিশ্বে এমন অসহযোগ কখনও দেখেনি কেউ!

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করেছেন অসহযোগের প্রতিটি দিন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন, আমরা কে কোথায় গেলে কী সাহায্য পাব।

`৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চারজনকে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে। সেখানে জাতীয় চার নেতাও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, `পড়ো, মুখস্থ করো।` আমরা মুখস্থ করলাম একটি ঠিকানা, `সানি ভিলা, ২১, রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কোলকাতা`। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, `এখানেই হবে তোমাদের জায়গা।

ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমি নিশ্চিত, ওরা আক্রমণ করবে। আক্রান্ত হলে এটাই হবে তোমাদের ঠিকানা। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করবে।` বঙ্গবন্ধু সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারকে তিনি আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। ডাক্তার আবু হেনা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু তাকে আগেই পাঠিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে।

সেই পথেই ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, মনি ভাই এবং আমাকে আবু হেনা নিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার এই রাজেন্দ্র রোডেই আমরা অবস্থান করতাম। আর ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন আমাদের জাতীয় চার নেতা। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারের ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টা করা হয়েছিল।

জাতীয় নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সব ভুল বোঝাবুঝি দূর করে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা স্বাধীন করেছি।

স্বাধীনতা ঘোষণার পর যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়, তখন এই জাতীয় চার নেতাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার পরিচালনা করেন ও বিজয় ছিনিয়ে আনেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দূরদর্শিতার সঙ্গে সুন্দর-সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সঙ্গে আমি বর্ডারে বর্ডারে ঘুরেছি, রণাঙ্গনে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছি। আমি থাকতাম কোলকাতায় মুজিব বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ব্যারাকপুরে, মনি ভাই আগরতলায়, সিরাজ ভাই বালুর ঘাটে আর রাজ্জাক ভাই মেঘালয়ে।

মেজর জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে দেরাদুনে ছিল আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুজিব বাহিনীর জন্য ভারত সরকারের যত সাহায্য-সহযোগিতা, সেসব আমার কাছে আসত। আমি আবার সেগুলো এই তিন নেতার কাছে পাঠিয়ে দিতাম। দেশ স্বাধীনের পর ২২ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের নেতৃবৃন্দকে তথা জাতীয় চার নেতাকে আমরা বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাই।

`৭২-এর ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে আমি মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেলাম। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকেছি শেষ দিন পর্যন্ত।

`৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এমনকি নিষ্পাপ রাসেলকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। যাতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করতে না পারে, সেই লক্ষ্য সামনে নিয়েই খুনিরা শিশু রাসেলকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়, জাতীয় চার নেতা হত্যারও মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের কেউ যেন নেতৃত্ব দিতে না পারে। খুনিরা মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য হয়ে ধ্বংস হবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আমাদের প্রিয় বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন। `৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পতাকা তুলে দিয়ে আমরা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

সেই পতাকা হাতে নিয়ে তিনি নিষ্ঠা, সততা, দক্ষতার সঙ্গে সংগ্রাম করে দীর্ঘ ২১ বছর পর `৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে গণরায়ে অভিষিক্ত করে সরকার গঠন করেন এবং অনেকগুলো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন।

আবার ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে বাংলাদেকে উন্নতির শিখরে তিনি নিয়ে গেছেন। আজ আন্তর্জাতিক বিশ্ব মনে করে, বিস্ময়কর উত্থান এই বাংলাদেশের! নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশ আজ অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে ধাবমান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক সব সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী।

বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটছে। জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করে প্রিয় বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা। মহান নেতাদের সেই চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই নেতৃবৃন্দের আত্মা চিরশান্তি লাভ করবে এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

tofailahmed69@gmail.com

/ এআর /