ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যে শোকগাথা শক্তির উৎস

মোহাম্মদ নাসিম

প্রকাশিত : ১১:২৮ এএম, ৩ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার

জন্মদাতাকে হারানোর বেদনা কতটা মর্মস্পর্শী, কতটা যন্ত্রণার, তা কেবল সন্তানই অনুভব করতে পারে। আমার বাবা এম মনসুর আলীকে হারানো আমার কাছে এতটা কষ্টের, এতটা শোকের যে, তা নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার কলম থেমে যায়। কী করে লিখি সেই দুঃখের স্মৃতি!

পিতার এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড কি কোনো সন্তান লিখতে পারে। তবুও আজ নিজ হাতেই লিখছি পিতার বিয়োগান্ত ইতিহাস।

৩ নভেম্বর এলেই বুকটা ভারি হয়ে যায়। নিজেকে পাথরসম যন্ত্রণাকাতর মনে হয়, চারদিকটা কেমন যেন অসহায় লাগে। `৭৫-এর ৩ নভেম্বর ভোররাতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামানের সঙ্গে আমার বাবা এম মনসুর আলীকে হারিয়েছিলাম।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদ যখন বাবা পেয়েছিলেন, তখন তিনি কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। আমি, মা ও ভাইবোন সবাই ভেঙে পড়েছিলাম। দেখলাম, বাবা শিশুর মতো অঝোরে কাঁদছেন। তারপর তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টেলিফোনে প্রতিরোধের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কাপুরুষের দল কেউ এগিয়ে আসেনি।

সহকর্মীদের পরামর্শে তিনি আত্মগোপনে চলে গেলেন। এ অবস্থায়ও দেখেছি- কী উদ্বেগ এবং প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন। অন্যদিকে প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে দলীয় সহকর্মী, তদানীন্তন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন।

আমি তখন বাকশালের পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমাকে গ্রেফতার করতে পারলেই হত্যা করা হতো। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই আমার বাবা মনসুর আলী আমাকে আত্মগোপনে থাকার নির্দেশ দিলেন।

মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির এক পরিচিতজনের বাসায় ১৬ আগস্ট গভীর রাতে তিনি আমাকে বিদায় জানালেন। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন। পরদিনই অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তিনি গ্রেফতার হলেন।

পরবর্তীকালে ৩ নভেম্বর ভোররাতে জেলখানায় নির্মমভাবে বাবাসহ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো। আমার জীবনের সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি আমি শুনতে পেলাম ৪ নভেম্বর। আমি তখন আত্মগোপনে। বাবাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ থেকেও আমি বঞ্চিত হলাম। সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত এ জন্য যে, শহীদ এম মনসুর আলী আমার বাবা।

যখনই আমি কোনো কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তা-চেতনায় সবসময় আমার পিতার জন্য আবেগ অনুভব করি। ছয় দফার আন্দোলনে যখন অনেক সহকর্মী বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগ করে চলে গেছে, কারাবন্দি অবস্থা থেকেও আমার বাবা শত প্রলোভন ও চাপের মুখেও তখনকার পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান, সালাম খানদের সঙ্গে হাত মেলাননি। বাবার দৃঢ় মনোভাব দেখেছি, ১৯৬৬-৬৭ সালে যখন তিনি পাবনা কারাগারে, আমিও বাবার সঙ্গে একই কারাগারে বন্দি।

দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম শেষে যখন `৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, তখন আমার বাবাসহ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন।

দুঃসাহসিক ও গৌরবময় সেই মুহূর্তগুলো আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। খন্দকার মোশতাকের মতো কয়েকজন সুযোগ-সন্ধানী মুজিবনগর সরকারের এই চারজন নেতার মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে হাজার মানুষকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন।

সহকর্মীদের উদ্দেশে তিনি সর্বদা বলতেন, বাঙালির বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশাল্লাহ মুক্ত করব। জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর বাবাকে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এম মনসুর আলী বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। জীবন দেব, তবুও তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে হাত মেলাব না। ৩ নভেম্বর কারাভ্যন্তরে জীবন দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর কথা রেখেছেন।

চারদিকে লক্ষ্য করি- লোভের কাছে, ভয়ের কাছে অনেক রাজনীতিবিদের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের ছবি। নীতিহীন আদর্শচ্যুত ব্যক্তিদের ঘন ঘন দলবদল, চেহারা বদল, ক্ষমতার জন্য নগ্ন প্রতিযোগিতা। এদের বিপরীতে মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় চার নেতা সাহস, ত্যাগ, নেতার প্রতি যে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস দেখিয়েছেন, তা বিরল ঘটনা।

তাঁরা জীবন দিয়েছেন কিন্তু নেতার রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেননি। বিশ্বের কাছে দেশবাসীকে ছোট করেননি। জাতিকে কলঙ্কিত করেননি। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার করে আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করেছেন। শহীদ এম মনসুর আলীর আদর্শ বুকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমৃত্যু কাজ করে যাব। ৩ নভেম্বর মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ পিতার প্রতি এটাই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

/ এআর /