ঐক্যফ্রন্টের পত্রমিতালী
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
প্রকাশিত : ০৬:২৯ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৭:০৮ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
“প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।।’
পত্রমিতালীর আমন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতার রাজপ্রাসাদে বসতি গড়ার স্বপ্ন সাজিয়ে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্টের বর্ষীয়ান নেতারা ‘চীজকেক রাজনীতিতে’ বেশ অনেকখানি এগিয়েছেন। তবে প্রথম দিকে ‘To be or Not to be’ অর্থাৎ ‘খাব কি খাব না’ এই দো-টানায় ভুগেছেন। না-খাওয়ার অভ্যাস থাকা ভাল। ‘মিতাহারী’ (!) রাজনীতিবিদ দেশ ও জাতির জন্য সকল সময়ে সুফল বয়ে আনে। অন্ততপক্ষে, বিরোধী-দলে থাকলে এক ঘন্টার ‘প্রতীকী অনশনের’ পরিবর্তে ‘প্রকৃত অনশনে’ তারা অংশগ্রহণ করতে পারবে অনায়াসেই। আন্দোলন সফল হতে বাধ্য!
সফল পত্রমিতালীর ফলে নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা-উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে গত পয়লা নভেম্বর প্রথমবারের মত ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে পয়লা সংলাপে বসে সরকার। সেসময় গণভবনে তিন ঘণ্টা ধরে দীর্ঘ আলোচনা হয় দুই পক্ষের মধ্যে। জাতি ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে – কি হয়! কি হয়! মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে শেষ হয়েছিল সরকারের সাথে ঐক্যফ্রন্টের প্রথম সংলাপ।কেউ ‘তুষ্ট’, কেউবা ‘অতুষ্ট’! তাও তো কিছু একটা হল। সরকার ‘অবৈধ’ বলে যারা এতদিন তুলোধুনো করে বেড়ালো, তারাই এখন সরকারের সাথে সংলাপ নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম । ‘কথা বলব না, বলেছি, শুনব না শুনেছি। কাছে আসব না, এসেছি, ডাকব না ডেকেছি।‘
নির্বাচন কমিশনের সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পত্রমিতালীও কিন্তু জাতির জন্য বিপুল আশাব্যাঞ্জক। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আমরা সকলেই জানি যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আগামী ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার সময় নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে, নির্বাচন কমিশনের কাছে লেখা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পত্রে অনুরোধ জানানো হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন যেন ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা না করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফা সংলাপের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করে। আচ্ছা, নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন, সংবিধান অনুযায়ী তার কাজ-কর্ম করবে। এখানে কোন ফ্রন্টে কি ঐক্য হচ্ছে তা নিয়ে কি চিন্তা করার সময় আছে তার?
তবে নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পত্রের প্রেক্ষিতে গত সোমবার (৫ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মিটিং হয় ঐক্যফ্রন্টের। সভায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সদস্যদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের উত্তপ্ত কথোপকথন হয়েছে বলে কিছু গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। গণমাধ্যম এমনটিও জানিয়েছে যে, ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা নেই বলে মন্তব্য করলে উত্তরে একজন কমিশনার বলেন, রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা নেই।
আস্থাহীনতার দোলাচালে আমরা সাধারন মানুষেরা বিভ্রান্ত, আমাদের স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা ভুলুন্ঠিত! তবে, স্বস্তির বিষয় হোল নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের মিটিং-এ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়নি। বরং সবার গলার আওয়াজ একটু উচ্চস্বরে ছিল। তাহলে ঠিক আছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে সব বর্ষীয়ান নেতারা রয়েছেন, এই বয়সে কানে শুনতে সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে। আর কানে যারা কম শুনেন তারা একটু উচ্চস্বরেই কথা বলেন। এটা মাথা ঘামাবার মত কোন ব্যাপারই না!
এদিকে পত্রমিতালীর রাজনীতি কিন্তু আরও ঘনীভুত হচ্ছে। প্রথম আলোচনার জের ধরে গত রোববার (৪ নভেম্বর) জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখে আবারো আলোচনায় বসার অনুরোধ জানান। চিঠিতে বলা হয়, পয়লা নভেম্বরের সংলাপের পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ বিষয়ে আরো আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
সেই সূত্র ধরেই পরবর্তী আলোচনার জন্য চিঠি দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। রাজনীতির অঙ্গনে সম্প্রীতি-সৌহার্দ আরও বাড়ুক, এটাই আমরা চাই। পত্রের বাণে জর্জরিত হোক দেশের রাজনীতির পোস্ট অফিস। কিন্তু তবুও ভাই পেট্রোল বোমা থেকে আমাদের রক্ষা করুন। বার্ন ইউনিটের গগন বিদারী হাহাকার আমরা শুনতে চাইনা। প্রয়োজন হলে পেশাজীবী পত্রলেখক নিয়োগ দিন, পত্রমিতালীকে সার্বজনীন করবার জন্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের পত্রের প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিএনপিসহ কয়েকটি দলের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে আগামী ৭ই নভেম্বর বুধবার বেলা ১১টায় আবারো সংলাপে বসবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ইতিমধ্যে বিবিসিকে জানিয়েছেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের সাথে এই সংলাপ হবে সীমিত পরিসরে। কারণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে উভয় পক্ষের অল্প সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এই সংলাপ চাওয়া হয়েছে। রাজনীতিতে পত্রমিতালীর সুবাতাস বইছে!
আমরা চাই সামনের নির্বাচন উৎসব মুখর হোক। পত্রমিতালীর রাজনীতি যেন দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। কিন্তু সাধু সাবধান! সুজন দেখে প্রেম করিও, কুজনে কখনও না। জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে এই সব পত্রমিতালী কখন যে ফতোয়ার জোরে ‘হারাম’ হয়ে যাবে এই ভয়ে থাকি। তখন কি হবে? জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন এখন হয়তো ক্ষমতার রাজপ্রাসাদে রাজভোগ খাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু সময় গেলে সাধন না-ও তো হতে পারে, সেটা ভেবে দেখেছেন কি?
লেখক : আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক।