ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতেই হবে

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ

প্রকাশিত : ১১:৩৮ এএম, ১০ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার

বৃহস্পতিবার গণভবনে বিভিন্ন ট্রাস্টের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে টেলিফোনে আমাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই শিক্ষকদের পাশে আছেন। তিনি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও সরকারি চাকরিজীবীদের মতো ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতার ঘোষণা দিয়েছেন।’

বর্তমানে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। তাদের ইনক্রিমেন্টের জন্য বছরে বাড়তি ৫৩১ কোটি টাকা লাগবে। আর বৈশাখী ভাতার জন্য লাগবে ১৭৭ কোটি টাকা। সরকার ২০১৫ সালে অষ্টম বেতন কাঠামোর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী ভাতা চালু করে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলা নববর্ষে তাদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে এ ভাতা পান। ওই বেতন কাঠামোতেই আগের সিলেশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের বিধান বাতিল করে ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্টের নিয়ম চালু করে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী মূল বেতন পেলেও বেতন ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা থেকে এত দিন বঞ্চিত ছিলেন।

ষাটের দশকে কলেজ জীবনে একটি সময়োপযোগী, বৈষম্য ও বঞ্চনামুক্ত শিক্ষানীতির জন্য আন্দোলন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ‘৭২-এ খুলনার একটি বেসরকারি কলেজে প্রথমে বিনা বেতনে, পরে মাসে ৬০ টাকার টিচার্স বেনিফিট সম্বল করে শিক্ষকতায় কর্মরত থাকি। বঙ্গবন্ধু সরকার ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় ওই বেনিফিটের অর্থ উন্নীত করেন এবং ১০০ টাকা দ্বিগুণ করার ঘোষণা দেন। ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষক শিক্ষা কমিশন গর্ব করে। ৫ মে ১৯৭৪ কমিশন বঙ্গবন্ধুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট তুলে দেয়। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী, গণমানুষের শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল পশু শক্তির নির্মম বুলেট জাতির প্রিয় পিতাকে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার পর শিক্ষার যাত্রা সার্বিক পশ্চাৎপদতার কাছে আত্মসমর্পণ করে। কুদরাত-এ-খুদা রিপোর্টের মূল বিষয়বস্তুকে ধারণ করে ২০০০ সালে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও তা কার্যকর হতে পারেনি। এর পর আবার নেমে আসে একরাশ অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারের দাপট চিরস্থায়ী হয় না। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করেন। এ শিক্ষানীতি প্রণয়নে আমি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলাম।

চার দশকের বেশি সময় শিক্ষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে এ অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে, শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য শেখ হাসিনার ঘোষণা তাদের মধ্যে একদিকে সন্তুষ্টি বয়ে আনবে, অন্যদিকে নতুন প্রত্যাশার জন্ম দেবে। এমপিওর জন্য নির্বাচিত শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি, অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সরকার প্রদত্ত বেতন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, প্রাথমিক-মাধ্যমিক থেকে শিক্ষার সব ধাপ ও স্তরে সমন্বয়, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও শিক্ষকের প্রাপ্য আর্থসামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণের মতো বিষয় এর মধ্যে রয়েছে।

আমি নিশ্চিত ছিলাম, শেখ হাসিনা বঞ্চিত করার নয়, বঞ্চনামুক্ত করার মানুষ। তবে প্রত্যাশা পূরণ যে নতুন করে প্রত্যাশা তৈরিও করে, শিক্ষক নেতৃত্ব ও সরকার উভয়কে তা অনুধাবন করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক আন্দোলনে ধারাবদলও যে অপরিহার্য, এ বিবেচনাও শিক্ষক নেতৃত্বের উপলব্ধিতে আসতে হবে।

৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতে চাই শিক্ষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা’ প্রতিপাদ্যে কৃতী শিক্ষকদের সম্মাননা, দুই শিক্ষার্থীকে সৃজনশীলতা ও সাহসী ভূমিকার জন্য প্রশংসা-সূচক স্বীকৃতি প্রদান ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শিক্ষা উন্নয়নে প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করা হয়। প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যুগোপযোগী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন। শিক্ষকদের মধ্যে যাদের সম্মাননা দেওয়া হয় তারা হলেন : ১. অধ্যাপক ড. সামসুল আলম, সিনিয়র সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়; ২. অধ্যক্ষ আওয়াল সিদ্দিকী, মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রবীণ নেতা, সদস্য, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটি; ৩. অধ্যক্ষ এমএ সাত্তার, বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী উদ্যোক্তা, শিক্ষক নেতা; ৪. মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ও নিয়মিত কলাম লেখক; ৫. অধ্যক্ষ অমিত রায় চৌধুরী, কলেজ অধ্যক্ষ, সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখক; ৬. মো. সিদ্দিকুর রহমান, প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রবীণ নেতা ও সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লেখক। নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার মেয়ে শিক্ষার্থী তসলিমা, সাহসী ভূমিকা দুওসু উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষার্থী এবং দেশের ৬৪ জেলার মাটি সংগ্রহ করে বাংলাদেশের মানচিত্র নির্মাতা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শুভঙ্কর পালকে অনুষ্ঠানে অভিনন্দিত করা হয়।

সভায় শিক্ষকদের পক্ষে অবস্থান ও প্রতিজ্ঞাপত্র উপস্থাপন করে শিক্ষা উন্নয়নে প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করেন মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রিয় নেতা, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. আজিজুল ইসলাম। আজকের লেখায় তার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে করি। অবস্থানে ছিল- ১. বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ; ২. বিশ্ব শিক্ষক দিবস জাতীয়ভাবে এবং প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালন করতে হবে; ৩. শিক্ষকদের জন্য ইউনেস্কো, আইএলও সুপারিশকৃত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের বিধানগুলো কার্যকর করতে হবে। শিক্ষায় ইউনেস্কো প্রস্তাবমতে অর্থ বরাদ্দ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে; ৪. মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য পৃথক নিয়োগ কমিশন গঠন করতে হবে; ৫. আনন্দদায়ক অনুকূল পরিবেশে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে; ৬. শিক্ষা আইন পাস ও বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে; ৭. শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে; ৮. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নসহ শিক্ষা উন্নয়নে প্রতিটি জাতীয় কর্মসূচিতে, এসডিজি ৪ বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিজ্ঞাপত্রে উল্লিখিত হয় : ১. বিষয়বস্তু যথাযথভাবে অবহিত হয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা। পাঠদানের ক্ষেত্রে গাইড বই, নোটবই ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে; ২. ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জানার আগ্রহ ও ঔৎসুক্য বৃদ্ধির জন্য তাদের শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করায় উৎসাহিত করা; ৩. ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান ও মানসিক নিপীড়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে; ৪. শিক্ষক মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন; ৫. ছাত্রী উত্ত্যক্তের প্রতিরোধ করতে নারী অভিভাবকসহ অভিভাবকদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে; ৬. দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে; ৭. ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানচর্চা পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমিত না রেখে সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চায় অংশগ্রহণে উৎসাহদান করা হবে; ১০. শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের জাতীয় কর্মসূচিতে শিক্ষা উন্নয়ন উদ্যোগ ও এসডিজি ৪ বাস্তবায়নে শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করবেন; ১১. শিক্ষকরা ২০২০ সালের মধ্যে প্রত্যেকে নিজস্ব ই-মেইল ঠিকানা চালু করবেন।

পরিশেষে শিক্ষা ও শিক্ষক দরদি শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। একই সঙ্গে এ প্রত্যাশাও ব্যক্ত করি যে, দলমতের ঊর্ধ্বে সব শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী শিক্ষা উন্নয়নে তার প্রতি আন্তরিক সহযোগিতা শুধু অব্যাহত নয়, সম্প্রসারিত করবেন। শিক্ষা পরিবারের মানুষ অকৃতজ্ঞ হতে জানেন না। আমি আশাবাদী, আগামী দিনগুলোতে এর সপক্ষে তাদের অবস্থান স্পষ্ট হবে।

(একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদের কলাম)