ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

শেষ হলো বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক-২০১৮

প্রকাশিত : ০৪:০৬ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত দুই দিনব্যাপী বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক-২০১৮ শেষ হয়েছে।  গতকাল সোমবার সম্মেলনের সমাপনী দিনের শেষ অধিবেশনের আলোচনায় দেশের অর্থনীতিকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান দেয়ার আহ্বান জানান বক্তারা।

রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-কি মেসেজ ফর দ্য নেক্সট গভর্নমেন্ট’ শীর্ষক ওই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমএ তসলিম, ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইজিএম) পরিচালক ড. মোহাম্মদ তারেক, প্রফেসর ড. স্বপন আদনান প্রমুখ।

অধিবেশনে বক্তারা বলেন, আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে যে নতুন সরকার আসছে, তাদের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, রাজনীতির উপরে অর্থনীতিকে স্থান দিতে হবে। বাংলাদেশে অর্থনীতি ও রাজনীতি দুটি পরাশক্তি হিসেবে কাজ করে। তবে সবসময় রাজনীতিই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারকে অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। সেজন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্র আছে। যেমন কয়েক সপ্তাহ ধরে তড়িঘড়ি করে অসংখ্য প্রকল্প পাস হচ্ছে। এগুলোর অর্থায়ন কোথা থেকে কীভাবে হবে, সেটি চিন্তা করা হয়নি। অনেকের নানা চাওয়া-পাওয়ার দিক দেখে এটি করা হয়েছে। পরবর্তী সরকার এসে প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন নিয়ে চিন্তা করবে। তাছাড়া নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে। বৈদেশিক লেনদেনে কিছুটা টানাপড়েন আছে। ফলে রিজার্ভ কমে গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দুর্বলতা বা কারসাজি রয়েছে। পরবর্তী সরকার নতুন করে মূল্যায়ন করতে পারে। সরকার একদিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, দুর্নীতি ও অন্যায়কে সুযোগ-সুবিধা দেয়, একই সঙ্গে কল্যাণমুখী ধারণাও বহন করে। দুটি একসঙ্গে হওয়াটা প্যারাডক্স। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে এবং কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে শিল্পায়ন করতে হবে। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রবৃদ্ধিকে দ্বিতীয় ধাপে নিতে হলে মেধার লালন করতে হবে।

ড. শামসুল আলম বলেন, আগামী মার্চ থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করা হবে। একই সঙ্গে ২০২২-২০৪১ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরির কাজও শুরু হবে। বাংলাদেশ যাতে মধ্য আয়ের ফাঁদে না পড়ে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ রয়েছে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় শত বছরের ডেল্টা প্ল্যান তৈরি হয়েছে, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, পায়রা বন্দর নির্মাণ ও মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুত করা হচ্ছে। আগামী দিন হবে মেগা প্রকল্পের দিন। বাংলাদেশের উন্নয়নে কোনো জাদু নেই, আছে পরিকল্পনা, গবেষণা ও সৃজনশীলতা।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতির মধ্য আয়ের হাইওয়েতে অবস্থান করছে। এজন্য সে অনুযায়ী জ্বালানি দিতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ যাতে মধ্য আয়ের ফাঁদে না পড়ে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, অর্থনীতি বহুমুখীকরণ করার দিকে আগামী সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উচ্চপ্রযুক্তির প্রয়োগ, শ্রমশক্তিকে বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে হবে।

ড. এমএ তসলিম বলেন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ড. তারেক বলেন, যখন কোনো একটি দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, তখন এটাকে ছেড়ে দেয়া বা অবহেলা করা উচিত নয়। সরকারের উচিত সেটি নিয়ন্ত্রণ করা। আগামী ১০-১৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অংকে নিয়ে যেতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক কেএএস মুর্শিদ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

বিনায়ক সেন বলেন, আর্থিক অনেক সূচকে নেতিবাচক অবস্থা দেখা যাচ্ছে, আগামী সরকারকে সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।

সম্মেলনের শেষ দিনে গতকাল অনুষ্ঠিত আরেক অধিবেশনে ‘অর্গানিক সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড দ্য আরবান পুওর ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মিতালী পারভিন ও আনোয়ারা বেগম। অধিবেশনটিতে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এটিএম নুরুল আলম।

প্রফেসর নুরুল আলম বলেন, ‘অর্গানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নজর দেয়া খুবই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৯৯১ সালে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ১৫ হাজার ৩৩৩ জন। ২০১১ সালে তা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২৯ জনে। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঢাকা শহরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেকারত্ব, পরিবেশদূষণ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

ঢাকায় প্রতিদিন মাথাপিছু দশমিক ৫৬ কেজি বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন ৩ হাজার ৮০০ টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশই অর্গানিক বর্জ্য। এসব বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। ফলে বর্জ্য পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে মিথেন গ্যাস, যা জনস্বাস্থ্যসহ গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

প্রতিবেদনে ঢাকার বাইরে গোটা দেশের শহরাঞ্চলের বর্জ্য উৎপাদনের একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালে দেশের শহরগুলোয় প্রতিদিন ৬ হাজার ৪৯৩ টন বর্জ্য উৎপাদন হতো। ২০০৫ সালে এসে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩০০ টনে। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি বেড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৪৭ হাজার ৫৪ টনে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে অর্গানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ নজর দেয়ার তাগিদ দেয়া হয় প্রতিবেদনে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্লাস্টিক, সিলভারসহ এ ধরনের বর্জ্যগুলো এখন কিছুটা রিসাইক্লিং করে পুনরায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু পুরো বর্জ্যের মধ্যে ৭৮ শতাংশ অর্গানিক বর্জ্যের কোনো ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। ঢাকা সিটি করপোরেশনের জনবল কম থাকায় তারা বর্জ্য সংগ্রহ করে জমিতে ফেলছে। ফলে সেখানে বর্জ্য পচে গিয়ে মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎস এবং বাতাস দূষিত করছে।

//এস এইচ এস//