ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

দুর্বলতার একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস

প্রকাশিত : ০৯:১৯ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১০:২১ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার

দূর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। সারা পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক ডায়াবেটিসের বিভিন্ন প্রকার এবং তাদের উপসর্গ ও লক্ষণ-

মূলত ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন ইনজেকশান প্রয়োজন হবে কি হবে না এর উপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিসের দুটি মূল বিভক্তি আছে।

১) ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস। এতে রয়েছে-

ক) শিশু- কিশোরদের ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস।

খ) প্রাপ্ত বয়স্কদের ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস।

২) ইনসুলিন প্রয়োজন নেই এমন ডায়াবেটিস।

এছাড়াও এমন একটা অবস্থা আছে যেক্ষেত্রে রোগী যথেষ্ট পরিমাণ শর্করা এবং ক্যালরি খেলে তার প্রস্রাবে সুগার আসবে এবং রক্তে সুগার বেড়ে যাবে। কিন্তু পরিমিত শর্করা খেলে রক্তে সুগার স্বাভাবিক থাকবে এবং প্রস্রাবে সুগার যাবে না। শর্করা জাতীয় খাদ্যের প্রতি এই ধরণের সহনশীলতার অভাবকে IGT (Impaired glucose tolerance) ‘গ্লুকোজের প্রতি সহনশীলতার অভাব রোগ’ বলে। এদের একটি বড় অংশ নিয়মকানুন না মানলে ভবিষ্যত পুরোপুরি ডায়াবেটিস রোগাক্রান্ত হবে।

ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস সংখ্যায়  আগে যেমন ছিল মোটামুটি তাই রয়েছে। কিন্তু ‘ইনসুলিন-নির্ভর নয়’ এমন ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা শুধু বেড়েছে তা নয়, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের সংখ্যাতত্ত্বের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়-

ক) এদের মোট সংখ্যা বেড়েছে।

খ) আগে যেমন মধ্য বয়সে( ৪৫-৫০ বা তার উর্দ্ব বয়সে) এ রোগের সূত্রপাত বেশি হত, যে জায়গায় আজকাল প্রায়ই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক মানুষের মধ্যেও এ রোগের সূত্রপাত হচ্ছে।

ডায়াবেটিস একটি জেনেটিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ। এর অর্থ হচ্ছে মানুষের গেহ কোষের ভিতরে  যে অসংখ্য জিন রয়েছে তাদের কোনো একটির মাধ্যমে (এই রোগ বংশ পরম্পরায়) নেমে আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। মা এবং বাবা দুজনের ডায়াবেটিস থাকলে এটা প্রায় নিশ্চিত তাদের সন্তানের ডায়াবেটিস হবে। এমনটি মা-বাবা-কাকাদের একজনের ডায়াবেটিস থাকলেও সন্তানের ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়।

রক্তে সাধারণত পরিমাণের চেয়ে সুগার বেড়ে গেলে তা নাস্তার আগে খালি পেটে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করলে এবং ভালো নাস্তার দু’ঘন্টা পর অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ পানিতে শরবত করে গুলে খাবার ২ ঘন্টা পর রক্ত এবং ঐসময় প্রস্রাব পরীক্ষায় ধরা পড়বে।

সাধারণত খালি পেটে রক্তে সুগার ৬.২ এম.এমওএল-এর বেশি হবে না। ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার পর রক্তে সুগার ৯.৫ এমওএল-এর বেশি হবে না। ডায়াবেটিস হলে রক্তের সুগার এ দুটি সংখ্যা অতিক্রম করবে এবং বিশেষ করে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার পর প্রস্রাবে সুগার আসবে। সকালে খালি পেটে রক্তের সুগার বেশি না হলে প্রস্রাবে সুগার না থাকারই সম্ভাবনা।

ইনসুলিন-নির্ভর নয়, এমন ডায়াবেটিসের রোগীরা প্রায়ই স্বাভাবিকের চেয়ে আগে থেকেই মোটা বা স্থুল হন। এদের আগের খাদ্যাভ্যাসে শর্করা ও চর্বির প্রতি আকর্ষণের ইতিহাস থাকে।

ডায়াবেটিসের সঙ্গে অনেকেরই রক্তেও চর্বির অধিক্য (cholesterol, TG বেশি) থাকে। রক্তে মেদ বাড়ার সঙ্গে হৃদরোগের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার এটাও একটা কারণ।

ডায়াবেটিসের দরুন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র  রক্তনালিগুলো আক্রান্ত হয়। এজন্য হৃদপিণ্ডে মাঝারি সাইজের রক্তনালি (করোনারি রক্তনালি), চোখের পেছনের পর্দার রক্তনালি( retina-এর ক্ষুদ্র রক্তনালি), কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালি  এবং পায়ের মাঝারি রক্তনালিগুলো সরু হয়ে যায়। কখনও কখনও সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যায়।

এ কারণেই ডায়াবেটিস নিয়মিত ৩- প্রকাম চিকিৎসা না করলে (পথ, নির্ধারিত ব্যায়াম ও ওষুধ) এসব রোগীদের অনেকেরই হার্ট, কিডনি এবং দৃষ্টির জটিলতা দেখা যায়। হার্টের করোনারি হৃদরোগ, চোখের রোগ এমনকি অন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কিডনি ফেইলউর এদের সবগুলোই মারাত্মক ধরনের হতে পারে।

ডায়াবেটিস থেকে পায়ের রক্তনালি ব্লক হয়ে গেলে গ্যাংগ্রিন বা পচন রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগের একটি টার্গেট হাত-পা এবং দূরাঞ্চলীয় স্নায়ুর রোগ-এদের বলা হয় Peripheral Neuropathy ।

এতে স্নায়ু অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। হাত-পা ঝিরঝির করা, অবশ বোধ, অনুভূতি কমে যাওয়া, Foot drop ইত্যাদি রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিসের সঙ্গে হাইপ্রেসারের জটিলতা ও চিকিৎসা না করলে বিপদজনক হতে পারে।

ইনসুলিন-নির্ভর নয় এমন ডায়াবেটিস পথ্য, ওষুধ এবং নির্ধারিত ব্যায়ামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত রাখা যায়। যেহেতু এতে নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশান প্রয়োজন হয় না, তাই অনেকে এটা হালকা ডায়াবেটিস মনে করে থাকেন।

কিন্তু এটা মোটেই সঠিক নয়। উপরে উল্লেখ করা ডায়াবেটিসের সবধরণের জটিলতা (হার্ট, কিডনি, চোখের অসুখ সবকিছু) এ ধরণের ডায়াবেটিসে হতে পারে। এমনকি গ্যাংগ্রিনও এ ধরণের ডায়াবেটিসে হতে পারে।

আরেকটা বিশেষ ধরণের জটিলতা  দু’ধরণের ডায়াবেটিসে হতে পারে।

১) হঠাৎ রক্তে সুগার কমে যাওয়া।

২) রক্তে অস্বাভাবিকভাবে সুগার বেড়ে যাওয়া।

নির্ধারিত খাবারের চেয়ে ১) কম খেলে, ২) বেশি ইনসুলিন বা ট্যাবলেট নিলে, ৩) হঠাৎ করে অনভ্যস্থ বেশি পরিশ্রম করলে, রক্তে সুগার কমে যেতে পারে।

এরকম হলে শরীর কাঁপতে থাকবে, শরীর ঘাম হতে থাকবে, খুব দুর্বল লাগবে, বুক ধড়ফড় করবে। এই অবস্থায় বেশ কিছুটা শর্করা (যথা-গ্লুকোজ অথবা চিনির সরবত)খেলে উপসর্গ কেটে যাবে। সঠিকভাবে এ রোগ নির্ণয়ের জন্য-

প্রস্রাব পরীক্ষা করে সুগারের অনুপস্থিতি এবং গ্লুকোমিটারে এক ফোঁটা রক্ত পরীক্ষা করে (যা নিজেই করা যায়) রক্তে সুগার দারুণ কমে যাওয়া এ ‍দুটোই নির্ণয় করা যায় সহজে।

রক্তে সুগার অনেক বেড়ে গেলে রোগী ধীরে ধীরে ‘কোমায়’ চলে যেতে পারে।অজ্ঞান হওয়ার আগে অস্বাভাবিক দুর্বলতাই প্রধান লক্ষণ হতে পারে।

অজ্ঞান অবস্থায়-

১) গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করলে রক্তে সুগার অনেক বেশি পাওয়া যায়।

২) প্রস্রাব (প্রয়োজনে ক্যাথেটার দিয়ে বের করে) পরীক্ষা করলে প্রচুর সুগার এবং ‘এসিটোন’ পাওয়া যাবে। এই অবস্থায় রোগী দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।

প্রথম পর্যায়ে রোগীকে বার বার রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। বার বার ইনসুলিন দিতে হয়। দেহের ইলকট্রোলাইট এবং পানির ভারসাম্য সঠিক করার জন্য ইলেকট্রোলাইট ও পানি জাতীয় ওষুধ দেহের ভেইনে ঢুকাতে হয়।

শরীরের কোথাও ইনফেকশান থাকলে (ফেঁড়া, কার্বঙ্কল, নিউমোনিয়া, প্রস্রাব ইনফেকশন) এবং গ্যাংগ্রিন থাকলে শক্তিশালী এন্টিবায়টিক তার জোরেসোরে চিকিৎসা করতে হবে। এসব শুধু হাসপাতালে সম্ভব। রক্তের সুগার বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে-

ক) নিয়ম ভঙ্গ করে ইচ্ছামত খাওয়া-দাওয়া।

খ) ইনসুলিন বা ওষধ ছেড়ে দেয়া।

হ) হঠাৎ করে ব্যায়াম করার অভ্যাস বন্ধ করে দেওয়া।

ঘ) শরীরে কোথাও ইনফেকশননের দরুন ইনসুলিন বা ওষুধের প্রয়োজন বেড়ে যাওয়া।

ডায়াবেটিস রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে আপনার চিকিৎসক ডায়াবেটিস চেক তো করেনই, সঙ্গে সঙ্গে হার্টে করোনারি রোগ হয়েছে কিনা, ব্রেন স্ট্রোক রোগ হয়েছে কিনা এবং কিডনি ফেল করেছে কিনা-এগুলো ও চেক করেন।

কেননা এর সবগুলোতেই রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। অবশ্য বেশি মাদকদ্রব্য, ব্রেনে ইনফেকশান, বেশি ঘুমের বড়ি খেলে ইত্যাদি কারণেও মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

(অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ‘রোগ চিনতে চান’ বই থেকে সংগৃহীত)

এমএইচ/