জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে ভ্যাকসিন :ডা. কাজী ফয়েজা অাক্তার
প্রকাশিত : ০৮:৪৭ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার
ডা. কাজী ফয়েজা অাক্তার
এ দেশের নারীরা কয়েক ধরনের রোগে বেশী আক্রান্ত হন। এর মধ্যে-পুষ্টিহিনতা, রক্তস্বল্পতা, জরায়ু মুখে ক্যান্সার এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার অন্যতম। ইউটেরাসের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হবার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে মহিলাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ জরায়ুর মুখের ক্যান্সার। বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই হচ্ছেন জরায়ু মুখের ক্যান্সারের শিকার। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার মহিলা জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে নতুন ভাবে অাক্রান্ত হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে জরায়ুর মুখের ক্যান্সার কেন হয়? এক ধরণের ভাইরাস এই ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এই ক্যান্সারের নাম হচ্ছে এইচপিভি। বা হিউমেন পেপুলুমা ভাইরাস। এই ভাইরাসটা সেক্সুয়াল রুটে একজন থেকে অন্য জনে ছড়ায়। এই ভাইরাসটা যখন জরায়ুর মুখে অাক্রমণ করে তখন জরায়ুর মুখে কিছু চেঞ্জ হয় ও শেষ অব্ধি তা ক্যান্সারে রূপ নেয়।
যেসব মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়, যেসব মেয়েরা অল্প বয়সে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে, যেসব মেয়েদের খুব ঘন ঘন প্রেগন্যান্সি বা ডেলিভারী হয়, যেসব মেয়েদের সিগারেট খাওয়ার হিস্ট্রি থাকে তাদের, যেসব মেয়েদের স্বামীরা অনেকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে - এমন ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাসে বেশী অাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
অামাদের ( ডাক্তার) কাছে যেসব রোগীরা অাসে তাদের অভিজ্ঞতায় যেটা বেশী দেখি তা হলো, একটা মেয়ের প্রচন্ড সাদা স্রাবের সমস্যা হয়। এই স্রাবটা খুবই দুর্গন্ধ হয়। পানির মতো হয়ে এই স্রাব নিঃসরিত হয়। অনেক সময় প্যাড বা কাপড় পড়তে হয় এই সাদা স্রাব রোধ করার জন্য।
এই রোগের জন্য এখন সরকারিভাবে একটা টেস্ট অাছে। একে বলা হয় `ভায়া`। এটা সব সরকারি হাসপাতালগুলোতে অাছে। এই `ভায়া` টেস্টটা বিনামূল্যে করা হয়। ভায়া টেস্টের মাধ্যমে দুটো জিনিশ নির্ণয় করা যায়। একটা হচ্ছে জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অাছে কী নাকি নেই। এজন্য ভায়া টেস্টের পর দুধরণের কার্ড দেয়। একটা হচ্ছে লাল কার্ড। অন্যটি হচ্ছে নীল কার্ড। নীল কার্ড যাদের দেওয়া হয়, তাদের বলা হয়, অাপনার জরায়ুতে এখনো পর্যন্ত ক্যান্সারের কোন লক্ষণ এখনো পর্যন্ত নেই। অাপনি তিন বছর পর অাবার পরীক্ষা করতে অাসবেন। অার যাদের লাল কার্ড দেওয়া হয় তাদের বলা হয় অাপনার জরায়ুতে ক্যান্সারের সম্ভাবনা অাছে। অাপনি নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে `কল্পোস্কপি` বা `বায়োপসি` করান।
তখন তারা অামাদের কাছে অাসে। অামরা তাদের জরায়ুর মুখ থেকে অল্প একটু টিস্যু নিয়ে বায়োপসি করি। বায়োপসি রিপোর্টে যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে তখন তার চিকিৎসা করা হয়।
জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু ভালো উপায় অাছে। সেটা হচ্ছে ভ্যাকসিন। অামাদের দেশে এখন দু`ধরনের ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে। একটা হচ্ছে সার্ভারিস্ক ভ্যাকসিন, অন্যটা হচ্ছে গার্ডাসী ভ্যাকসিন। তবে এই ভ্যাকসিনগুলো এখনো পর্যন্ত সরকারীভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এগুলো বিভিন্নন ভ্যাকসিন সেন্টারে টাকার বিনিময়ে দিচ্ছে। এতে তিন- চার হাজার টাকা একজন রোগীর খরচ হয়। প্রতিটা ভ্যাকসিন তিন ডোজ করে দেওয়া হয়। এই ভ্যাকসিন নিলে নারী মোটামুটি একটা প্রোটেকশানে থাকে যে তার জরায়ু মুখে ক্যান্সার হবে না।
তবে অামি যে এইচপিভি ভাইরাসের কথা বললাম তার অনেক টাইপ অাছে। হাজারটা টাইপ অাছে। অামাদের যে ভ্যাকসিন তা সর্বোচ্চ চারটা টাইপের বিরুদ্ধে কাজ করে। বাকি যে টাইপগুলো অাছে তার বিরুদ্ধে কিন্তু কাজ করে না। কাজেই কারো যদি এইচপিভি ভাইরাসের চারটা ধরণ ছাড়া অন্য কোন ধরণ দিয়ে অাক্রমণ করে তাহলে কিন্তু ভ্যাকসিন কাজ করেনা। তার মানে ভ্যাকসিন শতভাগ প্রতিরোধকারী তা কিন্তু নয়। অর্থাৎ ভ্যাকসিন নিলে তার অার কখনো জরায়ু মুখের ক্যান্সার হবে না এমন ধারণা ঠিক নয়।
যেসব ক্ষেত্রে স্বামী- স্ত্রী বা নারী পুরুষের একাধিক যৌনসঙ্গী অাছে বা খুব অল্প বয়সে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাদের অামরা কনডম ব্যবহার করতে বলি। একমাত্র এই পদ্ধতির মাধ্যমেই এই ভাইরাসটাকে প্রতিরোধ করা যায়।
জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের অাগ মুহুর্তে যদি ক্যান্সার ধরা পড়ে তাহলে লোকাল কিছু থেরাপী দিয়ে যেটাকে অামরা বলি `হট থেরাপী`। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই থেরাপী দেওয়ার ব্যবস্থা অাছে। অর্থাৎ ওই জায়গাটাকে পুড়িয়ে জীবানুটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এটাকে `ক্রায়ো` বলে। এছাড়া যদি ক্যান্সার হয়েই যায় সেক্ষেত্রে পুরো জরায়ুটাকে ফেলে দিতে হবে। এটা বিশেষ ধরনের জরায়ুর অপারেশন যার ফলে জরায়ু ও অাশে পাশের সম্ভাব্য এলাকা ফেলে দিতে হয়। শুধু অপারেশন করলেই সমাধান হয় না। পরবর্তীতে রেডিওথেরাপী দিতে হয়। ফুল কোর্স রেডিও থেরাপী দেওয়ার পরেও কিন্তু সারাজীবন ফলোঅাপ- এ থাকতে হয়। সারা জীবন কিছু পরীক্ষা নীরীক্ষা করে ছয় মাস - এক বছর পরপর ডাক্তারের কাছে অাসতে হয়। একবার যদি জরায়ুর ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু সারা শরীরে এমনকী ব্রেনেও পরবর্তী পভাব রেখে যেতে পারে।
জরায়ুমুখের ক্যান্সারটা খুব কমন ক্যান্সার। যেসব কারণে মেয়েরা এই ক্যান্সারে অাক্রান্ত হয় তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলে এই ক্যান্সার অনেকখানি প্রতিরোধ করা সম্ভব। অামি বলব, অাপনারা ভ্যাকসিনটা নিয়ে ফেলুন। ভ্যাকসিন শতভাগ না হলে ৭০-৮০% কাভারেজ দেয়। যেসব মায়েদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর, এমন মায়েদের বলি, অাপনারা অন্তত প্রতি তিন বছর পরপর ভায়া টেস্ট করুন। জরায়ুর মুখ সুরক্ষিত রাখুন।
লেখক: কনসালটেন্ট, ইমপালস হাসপাতাল। নারী রোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ।
অা অা//এসএইচ/