ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

উদ্বাস্তু জীবন থেকে বক্সিং রিংয়ে

প্রকাশিত : ১০:২৮ এএম, ১৮ নভেম্বর ২০১৮ রবিবার

বাড়ির বাইরে একটা জোরালো শব্দ। ‘কোন দিক থেকে এল রে?’  মায়ের চিৎকার। বাগানের দিক থেকেই তো মনে হল, বলল কেউ। কিছু ক্ষণ সব চুপ। আবার একটা শব্দ। দরজা খুলেই আঁতকে উঠলেন মা। সামনে পড়ে বড় ছেলের নিথর দেহ। গ্রেনেডের আক্রমণে স্তব্ধ।

আতঙ্কিত মা সে দিনই স্থির করলেন, পালাতে হবে। সোমালিয়া ছাড়তে হবে এখনই। সেই রাতেই শুরু করে দিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি। 

মা তো ঠিক করে ফেললেন, সোমালিয়া ছেড়ে যাবেন। কিন্তু কোথায়? কী ভাবে? রামলা, তার ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে তিনি উঠে পড়লেন নৌকোয়। গন্তব্যস্থল কেনিয়া। রামলা শোনালেন সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।

‘আমি তখন খুবই ছোট। তাই সেই নৌকো যাত্রার কথা খুব একটা মনে ছিল না। বড় হয়ে শুনেছি, অন্তত পাঁচশো মানুষ সেই নৌকোয় পালাচ্ছিল সোমালিয়া থেকে।’

নয়াদিল্লি থেকে যিনি এই কাহিনি শোনাচ্ছিলেন টেলিফোনে, তার নাম রামলা আলি। ভারতে সম্প্রতি এসেছেন বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে, রিংয়ে নেমে লড়াই করবেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায় তাদের বিপন্ন জীবন আর সেখান থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে এসে বড় হওয়ার অবিশ্বাস্য কাহিনি শুনতে শুনতে মনে হবে, রামলার জীবনটাই যেন একটা রিং। যেখানে প্রতিনিয়ত তাকে লড়তে হয়েছে মৃত্যু নামক প্রতিপক্ষের সঙ্গে।  

রামলা বলেন,  ‘পালিয়ে যাওয়ার সময় আমিও নাকি প্রায় মরেই যাচ্ছিলাম। ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাই।’ কোনওক্রমে নৌকো পৌঁছয় কেনিয়াতে। সেখান থেকে ক্রমে ইংল্যান্ডে। উদ্বাস্তু হিসেবে থাকতে শুরু করলেন তারা। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। উদ্বাস্তুকে কে জায়গা দেবে?

যাও বা ভর্তি হতে পারলেন, মোটাসোটা চেহারার জন্য প্রতি পদে অপমান। মানসিক যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখতে মা তাকে ভর্তি করে দেন ট্রেনিং সেশনে। এই সিদ্ধান্তই মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে গেল রামলার জীবনে। সেই প্রথম হৃদয়ে স্থান করে নিল বক্সিং।

কিন্তু জীবনে কোনও কিছুই সহজে হাতে পাওয়ার জন্য জন্ম হয়নি রামলা আলির। আবারও সমস্যা। রক্ষণশীল পরিবার মেয়েকে বক্সিংয়ের গা-দেখানো পোশাক পরতে দেবে না। ‘কেউ মেনেও নিতে চায়নি যে আমি বক্সিং করি। লুকিয়ে লুকিয়ে বক্সিং শিখতে যেতাম। একটা ছোট্ট ব্যাগে বক্সিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়িতে বলতাম পার্কে দৌড়তে যাচ্ছি,’ বলেন রামলা।

মাঝেমধ্যেই বাড়ি ফিরতেন চোখের কোণে কালশিটে নিয়ে। প্রতিপক্ষের ঘুসিতে কপালের পাশটা ফুলে থাকত। আড়াল করতে হুডওয়ালা জ্যাকেট পরে থাকতেন। কিন্তু চোখের নীচের কালো দাগ কী ভাবে মুছবেন? ‘মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলেছি, পা পিছলে পড়ে গিয়েছি। কখনও বলতাম, স্কুলে মারামারি হয়েছে। এ ভাবেই চালিয়ে গিয়েছি।’

অবশেষে নিমরাজি হয়ে মা বললেন, ‘চ্যাম্পিয়নশিপে নামতে পারো, তবে সোমালিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। মনে রেখো, ওটাই তোমার দেশ। তোমাকে সোমালিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে দেখলে অনেকের গর্ব হবে। পরে মায়ের কথা অনুযায়ী এগিয়ে গেলাম।’

ইংল্যান্ড ও ব্রিটেনের জাতীয় বক্সিং প্রতিযোগিতায় একাধিক মুকুট জিতেছেন রামলা। এখন পাখির চোখ করছেন অলিম্পিক্সকে। সেই লক্ষ্য নিয়ে ভারতের মতো আরও কয়েকটি দেশে বক্সিং রিংয়ে দেখা যাবে তাকে।

যিনি নিজেই অনেকের কাছে এত বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছেন, তার প্রেরণা কে? জিজ্ঞেস করায় রামলা বললেন ভারতের এক নারীর কথা। ‘মেরি কমকে দেখে আমি নিজেকে বলতে পেরেছিলাম, কে বলে মেয়েরা পারবে না? মেরি যদি পারেন, আমিও পারব। পাঁচ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন উনি। আমাদের কাছে মেরি কমই প্রেরণা।’

রামলার আশ্চর্য জীবনের গল্প শুনতে শুনতে এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি রামলা আলি নামে কেউ আছেন? না কি কেনিয়ার পথে নৌকোতেই হারিয়ে গিয়েছেন তিনি! গ্রেনেড আর গোলাগুলির হামলা থেকে সত্যিই কি রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি? সত্যিই পরে ফিরে গিয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়ায়, নিজের দেশের হয়ে বক্সিং রিংয়ে নামবেন বলে? এভাবেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার

এমএইচ/