হাই প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপে কী খাব, কী খাব না
পুষ্টিবিদ সোনিয়া শরমিন খান
প্রকাশিত : ০৭:০৫ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১১:১৩ এএম, ২২ নভেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
লেখক: সোনিয়া শরমিন খান
বর্তমানে সাধারণ রোগ গুলোর মধ্যে হাই প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ মোটামুটি ভাবে সেলিব্রিটি রোগ হয়ে গেছে। অনেকেই বলেন, আমি তো তরকারিতে খুব কম পরিমাণ লবণ খাই, কাঁচা লবণ তো প্রশ্নই ওঠে না। খাওয়া দাওয়ায় যথেষ্ট সচেতন থাকা সত্ত্বেও আমার ব্লাড প্রেশার হাই কেন? সারাজীবন প্রেশারের ওষুধ খাব? কিভাবে ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক থাকবে ?
পুষ্টিবিদ হিসেবে দায়িত্ববোধ থেকে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করি। আজ তাই আবারও জনস্বার্থে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস, কেন হাই প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ হয় এবং কিভাবে স্বাভাবিক রক্তচাপ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকব এই বিষয়টি নিয়ে ধারণা দেবার।
মূলতঃ রক্তচাপ ৮০ থেকে ১২০ এর বেশি হলেই তাকে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বলি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের রান্নার প্রানপ্রিয় উপাদান লবণকেই দোষারোপ করি। এর প্রধান কারণ হলো লবণ এর উল্লেখযোগ্য উপাদান সোডিয়াম এর বেশি মাত্রায় গ্রহণের কারণে রক্তের ভলিউম বা গতি বেড়ে যাওয়া, যাকে আমরা বলি উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার। রোগীদের মধ্যে তরুণ বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এই রোগটি এখন খুবই সাধারণ একটি বিষয়। আমাদের জানা দরকার সোডিয়াম দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি উপাদান। যা আমাদের দেহের তরল বা fluid ও ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্সকে রক্ষায়, খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা কমানো, হার্ট ও মস্তিষ্কের সুস্থতায় গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা রাখে।
যাইহোক, এখন অতিরিক্ত বা বাড়তি সোডিয়াম এর দোষ গুলো তুলে ধরি। বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে বাড়তি রক্ত সঞ্চালনে "সোডিয়াম" কে ব্যালেন্স করা উভয় কিডনির জন্য একটু কষ্ট সাধ্য হয়ে পরে। বাড়তি সোডিয়াম এর গলন বা dilution এর জন্য শরীর অতিরিক্ত পানি জমায় এবং একাধারে আমাদের দেহ কোষের চারিদিকে এমন কি রক্তেও fluid বা তরলের পরিমান বেড়ে যায় এবং একই সাথে রক্ত সঞ্চালন এর গতি ও বেড়ে যায়। রক্তের সঞ্চালনের গতি বেড়ে যাওয়া মানে রক্ত সঞ্চালন তন্ত্রের এবং হৃদযন্ত্রের কাজ বেড়ে যাওয়া। সময়ের সাথে বাড়তি কাজের চাপে রক্তনালি গুলো এবং হৃদযন্ত্র দূর্বল হয়ে পরে, যার ফলশ্রুতিতে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেশার বা হাইপার টেনশন হয়।
এছাড়াও হার্ট এটাক, স্ট্রোক এমনকি হার্ট ফেইলিওর ও হতে পারে। এমনও কিছু বিষয় দেখা যায়, অতিরিক্ত সোডিয়াম রক্তচাপ কে স্বাভাবিক রেখেও কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, হার্ট, আর্টারী এবং কিডনি ড্যামেজেও ভুমিকা পালন করে। শুধু তাই নয় আমাদের হাড়ের ক্ষয়ের জন্যও অতিরিক্ত সোডিয়াম পরোক্ষভাবে দায়ী। বিষয়টি আমার কাছে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাই একটু বুঝিয়ে বলি, অতিরিক্ত সোডিয়াম গৃহীত হলে আমাদের দেহ থেকে যতটুকু ক্যালসিয়াম ইউরিনের মাধ্যমে সাধারন ভাবে বের হয় তার পরিমান টা অনেকটাই বেড়ে যায়। ফলে রক্তে ক্যালসিয়াম এর মাত্রা কমে গেলে হাড় বা। bone থেকে এই ক্যালসিয়াম রক্তে লিক হয় বা চলে আসে যার ফলে the bone thinning disease বা osteoporosis/অস্টিওপরোসিস নামে খ্যাত হাড়ের রোগ হয়। সুতরাং যে খাদ্য তালিকায় সোডিয়াম এর আধিক্য থাকে, গ্রহনকারীর ক্যালসিয়াম এর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাছাড়াও পাকস্থলীর ক্যান্সারের কারণ হিসাবেও সোডিয়াম কে দায়ী করা হয়। তাই রক্তের পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেয়া উচিত দেহে সোডিয়াম এর মাত্রা কতটুকু।
এখন আসি এই সোডিয়াম এর চাহিদা এবং উৎস কি? আমাদের দেহে এর প্রয়োজনীয়তা দিনে ২৩০০ মি.গ্রা. এর ও কম, যার মধ্যে আদর্শ চাহিদা দিনে ২০০০ মি.গ্রা. ধরা হয় এবং এই পরিমান সোডিয়াম আমরা পাই মাত্র ৫ গ্রাম বা ছোট এক চামচ লবণ থেকেই। সাধারণত আমাদের সারাদিনের রান্নার লবণের পরিমাণ হয় ৬ গ্রাম থেকে ১২ গ্রাম যার মধ্যে সোডিয়াম থাকে ২৩০০ থেকে ৪৬০০ মি.গ্রা. পর্যন্ত। এখন প্রশ্ন হল সোডিয়াম কি আমরা শুধু লবণ থেকেই পাই ? যার জন্য যত দোষ নন্দঘোষ এর মত লবণেরই সব দোষ হয়?
এখন বলি আর কোন কোন উৎস থেকে সহজেই আমাদের দেহে সোডিয়াম এর মাত্রা বেড়ে যায় আমাদের অজান্তেই। আর সেগুলো হলো,বাটার মিল্ক এবং দুধ জাতীয় খাবার, চিজ, বেকিং পাউডার ও সোডা, বেকড খাবার, টেস্টিং সল্ট, সয়া সস, সালাদ ড্রেসিং, বাজারের বিভিন্ন প্যাকেটজাত স্বাদ বর্ধক মশলা, টমেটো সস, চিপস, বিভিন্ন রকম আচার, টমেটো, জলপাই, সরিষা, পালং শাক, বিটরুট, নারকেলের দুধ ও নারকেল, ইন্সট্যান্ট স্যুপ, নুডলস, রোস্টেড বাদাম বিশেষ করে টিনজাত বাদাম ও বীচি (মিষ্টি কুমড়ার বীচি), টিন ও প্যাকেটজাত স্ন্যাক্স, ফাস্টফুড, প্রসেসড মাছ/মাংস, ইত্যাদি। সুতরাং, খাদ্য তালিকা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কম সোডিয়াম যুক্ত কিন্তু বেশি পটাশিয়াম যুক্ত সবুজ শাক সবজি এবং রান্নার উপাদান ব্যবহার এ সতর্কতা অবলম্বন করে, নিজের ক্যালরির চাহিদা ও পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান এর সমন্বিত খাবার খেয়ে, কিছু শারীরিক পরিশ্রম বা এক্টিভিটি করে, সুস্থতা বজায় রেখে জীবন কাটানো সম্ভব।
হাই প্রেশার হলে যা খাবো
জেনে রাখা ভাল, যারা হাই প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ এ ভুগছেন, তারা যদি পটাশিয়াম সম্বলিত খাবার খান তবে তা রক্ত নালীর সুস্থতা রক্ষা এবং ইলেকট্রোলাইটস ব্যালেন্স সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এই জাতীয় খাবার গুলো হলো, আলু, মিষ্টি আলু, বাদাম বিশেষ করে কাঠবাদাম, কাজু বাদাম, বিভিন্ন সাদা বীচি, টমেটো, পালং শাক,কচু, মুলা, কমলা, মাল্টা, লেবু, কলা, ডাবের পানি এবং অন্যান্য শাক সবজি। এখানে উল্লেখ্য, সোডিয়াম এর এর মাত্রা কে ব্যালেন্স করতে পটাশিয়াম এর ভুমিকা অপরিসীম। তাই হাই প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ এর রুগীদের খাবার গ্রহণে পটাশিয়াম সম্বলিত খাবার এর পরিমান বাড়িয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা বা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিঃ দ্রঃ শুধুমাত্র উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেশারের রোগীদের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যান্য রুগী বিশেষ করে কিডনী রুগীর কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের জন্য খাদ্য বাছাই ও রান্নার প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা রয়েছে।
লেখক: সোনিয়া শরমিন খান
নিউট্রিশনিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান, সিটি হেলথ সার্ভিসেস লিমিটেড, ৭৭২/১ এ, বসিলা রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
এসি