ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

তাজরীন ট্রাজেডির ৬ বছর

বদলে গেছে দেশের পোশাক শিল্প

প্রকাশিত : ০৫:৪২ পিএম, ২২ নভেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

রাজধানী ঢাকার অদূরে তোবা গ্রুপের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড নামের কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আজ থেকে ৬ বছর আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরের ওই ঘটনায় প্রাণ হারায় শতাধিক শ্রমিক। এরপর বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোয় নিরাপত্তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবী কারখানা মালিক ও সরকারের। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছেন কারখানায় সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করার মত পরিস্থিতি এখনও হয়নি। তবে কারখানা মালিকরা বলছেন, অগ্রগতি অনেকটাই হয়েছে, ``কাজ বাকি আছে সামান্যই``।

৬ বছর আগে তাজরীনের আগুনে পুড়ে অন্তত ১শ ১৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আর আহত হন দেড় শতাধিক শ্রমিক। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন মারা যায় আরো ৯ জন। মোট ১২৬ জন শ্রমিক প্রান হারায় তাজরীনের আগুনে। আর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গহানিসহ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক।

বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের প্রধান খাত পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় অর্ধ কোটিরও বেশি। নারী শ্রমিকের এ এক বিরাট কর্মস্থল। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় অনেকের মধ্যে কর্মস্থলে দুর্ঘটনার একটা ভয় কাজ করে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, "আমরা তো সরাসরি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলি আর আমাদের লুকোনোরও কিছু নেই। সে অবস্থান থেকে আমরা কিন্তু দেখি যে শ্রমিকরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বোধ করছেন এরকম অবস্থা কিন্তু এখনো হয়নি।"
কারখানা পরিদর্শনের বিষয়ে তিনি বলেন,"ধরেন আপনি একটা স্পটে যাবেন, মালিকপক্ষ জানলো যে আপনি যাবেন, সেজন্য তারা কিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখলো। কিন্তু পরবর্তীতে তারা সেটা সরিয়ে ফেললো। তাহলে আপনি কী করবেন? এজন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর যারা আছেন তাদের দিয়ে সরকারের একটা সার্বক্ষণিক তদারকি রাখতে হবে,"

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ট্রাজেডির ৫ মাসের মাথায় সাভারের রানাপ্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক খাতে নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানা সংস্কারের জোর দাবি উঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে রফতানি করে, এমন দুই হাজার দুইশ’ কারখানা সংস্কারে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে ৫ বছরের জন্য আলাদা দুটি জোট গঠিত হয়। ওই জোটভুক্ত কারখানাগুলোর সংস্কার অগ্রগতি ৯০ শতাংশের উপরে। তবে এ দুটি জোটভুক্ত ক্রেতাদের কাছে পোশাক রফতানি হয় না, এমন দেড় হাজার কারখানা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের শুরুতে উদ্যোগ নেয় সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়।

অ্যাকর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে সোয়া দুইশ’ বায়ার ও ব্র্যান্ড। অবশ্য অ্যাকর্ডের বেশকিছু কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার ও কারখানা মালিকদের সঙ্গে অ্যাকর্ডের দূরত্ব তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতেই বাংলাদেশকে না জানিয়ে ফের তিন বছরের জন্য ‘২০১৮ অ্যাকর্ড’ নামে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় অ্যাকর্ড। অবশ্য ওই সিদ্ধান্তে সম্মতি জানিয়ে স্বাক্ষর করা ব্র্যান্ডের সংখ্যা ৫০ এর কিছু বেশি।

পোশাক খাতে বর্তমান নিরাপত্তা নিয়ে অ্যাকর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, কারখানা ভবনের নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজ এখনও অনেক বাকি আছে।
"কারখানায় নিরাপত্তার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু একই সঙ্গে অনেক ত্রুটি সংশোধন করছেন কারখানা মালিকপক্ষ, এসব কাজ এখনো শেষ হয়নি। অনেক কারখানায় নূন্যতম জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপগুলো নেয়া হলেও মানসম্মত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু কাজ এখনো বাকি রয়েছে। যেমন কারখানার সবখানে ফায়ার এলার্ম, ষ্প্রিংঙ্কলার সিস্টেমসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম স্থাপনের মতো কাজ বাকি রয়েছে। ভবনের নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজও অনেক কারখানায় এখনো হয়নি।"

ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড বাংলাদেশের ১৮শর বেশি কারখানায় আগুন, বিদ্যুৎ ও ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছেন।
"অ্যাকর্ড নির্ধারিত ১৮শ কারখানায় চিহ্নিত ৯০ হাজারের মতো ত্রুটি সংশোধন হয়েছে। এখনো প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজারের মতো ত্রুটি সংশোধন প্রয়োজন যার মধ্যে অনেকগুলোই মৌলিক জীবনরক্ষাকারী নিরাপত্তা পদক্ষেপ,"

বিজিএমইএ’র তথ্যে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ও সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এ পর্যন্ত ১৩শ একটি কারখানা বন্ধ হয়েছে তবে নতুন করে তৈরি হয়েছে ৭২৩টি কারখানা। তবে অ্যাকর্ডের কথার সূত্র ধরে বিজিএমইয়ের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান দাবি করেন যেসব কাজ বাকি তা নিতান্তই যৎসামান্য। জীবনরক্ষাকারী বেশিরভাগ কাজই ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

"দেখা যাবে কারো ৫ পার্সেন্ট কাজ বাকি আছে, কারো হয়তো একটা পাম্প লাগানো বাকি আছে এরকম। সেই হিসেবে আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস সেক্টর, সেই সেক্টর এখন পৃথিবীর যেকোনো দেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির থেকে বিল্ডিং সেফটি, ফায়ার সেফটি এবং ইলেকট্রিকাল সেফটি- এই তিনটা ইস্যুতে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে।"

পোশাক খাতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স জানায়, তাদের আওতাভুক্ত কারখানাগুলোয় নিরাপত্তা অগ্রগতি শতকরা ৮৫ ভাগ আর ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের অগ্রগতি শতকরা ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবী করেন। মেয়াদ শেষে আগামী বছর বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে অ্যালায়েন্স।

তবে ইউরোপীয় ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ডের মেয়াদ ২০১৮ সালে শেষ হলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা থাকতে চায়। কিন্তু কারখানা মালিকরা চাননা কোনোভাবেই অ্যাকর্ডের মেয়াদ বাড়ুক। বাংলাদেশ সরকারও অ্যাকর্ডের মেয়াদ না বাড়ানোর পক্ষে।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, "অ্যালায়েন্স চলে যাওয়ার পর অ্যাকর্ডেরও আর কোনো কাজ নাই। দেশের কারখানাগুলি এখন আর ঝুঁকিপূর্ণ নেই। তিনশ`র মতো কারখানা এখন গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরিত হতে চলেছে। ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা খরচ করে পুরনো কারখানাগুলোকে আধুনিক করা হয়েছে। আগে যেসব ঝুঁকিপূর্ন ভবন ছিল সেগুলোও এখন বাদ দেয়া হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের কারখানাগুলো এখন চমৎকার।"

বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়েই ভবিষ্যতে কারখানার তদারকি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর আছে, বেপজায় ইন্সপেক্টর আছে। সরকার চায় তারাই এগুলো তদারকি করবেন।

আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকান্ড ও সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের পর মালিকপক্ষের পাশাপাশি শ্রমিকরা অনেক সচেতন হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন সময় ছোটখাট বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের ঘটনা ঘটলে সব শ্রমিক নিরাপদে চলে যাবার চেষ্টা করেন। প্রতিটি কারখানার বহুতল ভবনেও স্থাপন করা হয়েছে জরুরী বহির্গমনের সিঁড়ি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা যেমন সচেতন হয়েছে তেমনি তাদের বেতন-ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অনেকটা সজাগ। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন-ভাতা সময় মতো প্রদান না করলে তারা শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ থেকে শ্রম আদালতে সালিশ করতেও পিছপা হয় না। কারখানা মালিকগনও এখন আগের চেয়ে অনেক পরির্বতন হয়েছেন। প্রতি মাসের ১ম ও ২য় সপ্তাহের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদান করছেন। ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ট্রেজেডি ও ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন অনেকেই। অতীতের সব কিছুকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে এই শিল্প। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) কর্তৃক বাংলাদেশের ৬৭টি কারখানা অর্জন করেছেন ‘দ্যা লিডারশিপ এনার্জি এনভারনমেন্ট ডিজাইন’ (এলইইডি) সনদ। যেখানে পাশ^বর্তী দেশ ভারতের ৫টি কারখানা এই সনদ অর্জন করতে পেরেছ। শীঘ্রই বাংলাদেশের আরো ২৮০টি পোশাক কারখানা ‘দ্যা লিডারশিপ এনার্জি এনভারনমেন্ট ডিজাইন’ (এলইইডি) সনদ পেতে যাচ্ছেন বলে বিজিএমই সূত্রে জানা গেছে।

আরকে//