গণঅভ্যুত্থান, চিকিৎসক সমাজ ও শহীদ ডা. মিলন
প্রকাশিত : ০১:৩৮ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:৩৪ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৮ শুক্রবার
২৭ নভেম্বর ১৯৯০। এদিন ছিল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও চিকিৎসকদের ২৩ দফা বাস্তবায়ন আন্দোলনের এক পর্যায়ের কর্মসূচি- সারাদেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং পিজি হাসপাতালের বটতলায় সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশ। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর উত্তপ্ত এবং সমাবেশ-মিছিল-স্লোগানমুখর। এরশাদের সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী শহীদ মিনার থেকে চানখাঁরপুল ও দোয়েল চত্বর দখল নিয়েছে। গত রাতে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য বেশ কয়েক দফা তাড়া করে সরিয়ে দিয়েছে। বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি, বোমাবাজি চলছে থেকে থেকে। ডাকসুসহ সব ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন তখন ঘোষণা দিয়েছে-‘স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না।’
২৫ নভেম্বর ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সরকারি ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া গেল। ডা. মিলন তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক আর আমি প্যাথলজি বিভাগের। প্রতিদিন সকালে ওর তিনতলার বিভাগে এসে কাজ সেরে আমাদের দ্বিতীয় তলার প্যাথলজি বিভাগে চলে আসত এবং কলেজ-হাসপাতাল ঘুরে আমরা আন্দোলন সংঘটিত করতাম অন্যদের সঙ্গে নিয়ে। ২৬ নভেম্বর ডা. মিলন যথারীতি সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ওর বিভাগ হয়ে আমার বিভাগে এলো। দু`জনে মিলে কলেজ ও হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে আগামীকালের বিএমএর কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জনসংযোগ করলাম। হাসপাতালের ডক্টরস ক্যাফেটোরিয়ার বন্ধু ডা. রঞ্জুসহ দুপুরের খাবার খেয়ে ওদের বিদায় দিতে গিয়ে দেখলাম, শহীদ মিনার থেকে চানখাঁরপুল এবং দোয়েল চত্বর সশস্ত্র যুবকদের দখলে, প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী- সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সঙ্গে চলছে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ।
২৭ নভেম্বর সকালে মিলনের অপেক্ষায় থেকে না পেয়ে আমি আর সাইদ পিজি হাসপাতালের দিকে যেই পা বাড়িয়েছি, ঠিক তখনি খবর পেলাম, টিএসসির সামনে একজন চিকিৎসক গুলিতে আহত হয়েছে- তাকে ইমার্জেন্সিতে আনা হচ্ছে। আমরা দৌড়ে ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখলাম, ডা. আমজাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে মিলনকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
মুহূর্তেই বিদ্যুতের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মান্তিক সংবাদ- গর্জে ওঠে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ, জনপথের সর্বত্র জনগণের কণ্ঠ- `মিলন ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না।` আন্দোলন ঝড়ের গতি পায়, যে ঝড়ে কোনো রাজন্য, কোনো স্বৈরাচার কখনও টিকে থাকতে পারে না। চারদিক থেকে চিকিৎসক-ছাত্র-জনতা বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা এক মহাসমুদ্রে পরিণত করে। এখানে তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কবির উদ্দীন আহমেদ কলেজের শিক্ষকদের পদত্যাগের ঘোষণা করেন এবং বিএমএর নেতা ডা. ইউনুস আলী সরকার দেশের সব চিকিৎসককে পদত্যাগের জন্য আহ্বান জানান। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এসজিএম স্যারের রুমে বিএমএর এক জরুরি সভার আয়োজন করি। এ সভায় কয়েকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয় : ১. ২৮ নভেম্বর বিএমএর পক্ষ থেকে সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান; ২. অবিলম্বে এরশাদ সরকারের পদত্যাগ দাবি; ৩. এরশাদ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম চিকিৎসক কর্মবিরতি। তৎকালীন সব রাজনৈতিক জোট বিএমএর সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচিকে সমর্থন করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেদিনের সব আয়োজনের দায়িত্ব বর্তেছিল আমার ওপর। পরিস্থিতি এমনই হতবিহ্বল ছিল, মিলনের মৃত্যু সনদটিও আমাকে লিখতে হয়েছিল। মিলনকে শায়িত করার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেলাম, এরশাদ সরকার ইতিমধ্যে কারফিউ জারি করেছে। ঘোষণা করেছে জরুরি আইন; ব্যবহার করল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার শেষ অস্ত্র। জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল সেই ঘোষণা। ঘোষণার রাতেই কারফিউ ও জরুরি আইন অমান্য করে লাখো মানুষের ঢল নামল ঢাকার রাজপথে ও সারাদেশে। ২৮ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সব মেডিকেল শিক্ষক ও সরকারি চিকিৎসক পদত্যাগ করে এরশাদ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানান।
ডা. শামসুল আলম খান মিলন তৎকালীন বিএমএর যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ডাক্তার হওয়ার পর থেকে চিকিৎসক ও পেশাজীবীদের সব আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে নেতৃত্ব প্রদান করেন। প্রতিটি আন্দোলনে তাকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে; এমনকি চাকরিচ্যুত পর্যন্ত হতে হয়েছে। যদিও চিকিৎসক পেশাজীবীদের চাপের মুখে সরকার বারবারই তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে। মিলন তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এ দেশের চিকিৎসক, পেশাজীবী ও রাজনীতিবিদদের হৃদয়ে এক মর্যাদাকর আসন অর্জন করেছিল। অমায়িক ব্যক্তিত্বের মানুষ মিলনের সঙ্গে ঢামেক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। আমি জয়ী হলে ওকে কোষাধ্যক্ষ পদের প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যান করেনি। দিনরাত একসঙ্গে বিএমএ, শিক্ষক সমিতি, পেশাজীবী আন্দোলনে কাজ করেছি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আন্দোলন সংঘটিত করার জন্য গোটা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি হুলিয়া মাথায় নিয়ে রাতে হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে দু`জনে একসঙ্গে ঘুমিয়েছি।
’৯০-এর প্রথম দিকে সরকার কর্তৃক একটি স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণার কথা শোনা যায়। অবশেষে সে বছর ২৫ জুলাই জেনারেল এরশাদ জাতীয় প্রচারমাধ্যমে একটি ‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি’ ঘোষণা করেন। বিএমএ ও জনগণ এই স্বাস্থ্যনীতিকে পর্যালোচনা করে যুক্তিযুক্তভাবে এ প্রস্তাবকে গণবিরোধী এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে এনজিওনির্ভর করার অপচেষ্টা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। ২৭ জুলাই বিএমএ পর্যায়ক্রমে আন্দোলনের শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় চিকিৎসক মহাসমাবেশ থেকে গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও চিকিৎসকদের প্রাণের ২৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে। চিকিৎসকদের এ আন্দোলনকে দেশের তৎকালীন তিন জোট, সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য, অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠন সমর্থন করে। তুমুল আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকার ১৪ আগস্ট স্বাস্থ্যনীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সুসংগঠিত হতে থাকে, তিন জোট ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর মধ্যে ২৭ নভেম্বর মিলন শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে দ্রুত স্বৈরাচারী সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের পতন ঘটে।
ডা. মিলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ দেশের চিকিৎসক সমাজ তথা বিএমএ, পেশাজীবী সমাজ জনগণের কাছে এক মর্যাদার আসন পেয়েছে।
আমাদের একটি দুঃখ থেকেই গেল, ডা. মিলন হত্যার বিচার হলো না। মিলনের রাজনৈতিক আদর্শের দল ক্ষমতার অংশ হিসেবে থাকলেও মিলন হত্যার বিচার করার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
ইতিমধ্যে দেশের মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার তিন দফায় দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিসহ চিকিৎসকদের সব দাবি পূরণ করেছেন। নবীন চিকিৎসকদের সরকারের সাধ্যমতো নিয়োগ হচ্ছে। বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন বিশ্বের দরবারে সমাদৃত, অনেক ক্ষেত্রেই ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জনগণের পূর্ণ সন্তুষ্টি পাওয়া সহজ নয়। কারণ স্বাস্থ্য বাজেটের অপ্রতুলতা, রোগীর অকল্পনীয় চাপ, দুর্বল ব্যবস্থাপনাসহ রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। তারপরও আমাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে সর্বস্তরে। নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ কিন্তু প্রধানত চিকিৎসকদের হাতে।
আজকে শহীদ ডা. মিলনের ২৮তম শাহাদতবার্ষিকীতে শহীদ ডা. আলীম, শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী, শহীদ ডা. মিলনসহ লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা এ দেশের চিকিৎসক সমাজ চিকিৎসাক্ষেত্রে ভেদাভেদ ভুলে দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ মেধা, শক্তি, সুযোগ ব্যয় করব- এটিই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/