ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

৮ হাজার কোটি টাকার নির্বাচনি ব্যয়ে চাঙ্গা অর্থনীতি

প্রকাশিত : ০৯:০৬ পিএম, ২ ডিসেম্বর ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৩:৩০ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ফুলে ফেপে উঠছে ভোটের অর্থনীতি। চায়ের দোকান থেকে বিলাসবহুল শপিং মলে চলছে নির্বাচনি আড্ডা ও প্রচার-প্রচারণা। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি আসনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে একজন প্রার্থী এর চেয়ে অনেক বেশি খরচ করে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে এবারে প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়াও নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের জন্য সরকার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এক হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। যে অর্থ সংসদীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনে ব্যয় করা হবে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার জন্য ৭০০ কোটি টাকা চেয়েছে।

কমিশন সূত্রে জানা যায়, মনোনয়ন বাতিলের পর এবার জাতীয় নির্বাচনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা তিন হাজার ৬৫ জন। আইন অনুযায়ী প্রতি প্রার্থী খরচ করতে পারবেন ২৫ লাখ টাকা করে। কিন্তু কমিশনের বেঁধে দেওয়া এ ২৫ লাখের বাইরে কোনো কোনো প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় যে ১০ কোটি টাকার অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করছেন নির্বাচন বিষেজ্ঞরা।  

নির্বাচনের এ বিপুল খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবীদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে এ বিপুল পরিমান অর্থ খরচ সাময়িকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই এ খরচের পরিমানের চেয়ে এর উৎস্য কোথায় সেটা অনুসন্ধান করা জরুরি। টাকার এ বিস্তারকে কাজে লাগাতে বিনিয়োগের ওপর জোর দিতে হবে।

দেশের নির্বাচনে কী পরিমাণ ব্যয় হয়, সে ব্যাপারে সরকারি কোনো গবেষণা নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) এক গবেষণা বলছে, নির্বাচনি ব্যয়ের হার প্রতি বছরই ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে।সে হিসেবে এবার নির্বাচনি অর্থনীতির আকার আট হাজার কোটি টাকার বেশি।

জানতে চাইলে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে সৎ ও যোগ্যপ্রার্থী আসবে না। এতে সুশাসন ব্যাহত হবে। তারমতে, ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত এগুলোর পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ আবশ্যক। এজন্য অডিটর নিয়োগ করা যেতে পারে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৪৪বি (৩এ) উপধারা অনুসারে বর্তমানে ভোটার প্রতি প্রার্থীদের ব্যয় আট টাকা। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত ব্যয়ের সীমা প্রার্থীরা মানেন না। ভোটার প্রতি প্রার্থীরা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে থাকেন।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ। এক্ষেত্রে ভোটার প্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ৮ টাকা। প্রতি আসনে ১০ জন করে প্রার্থী হলেও মোট নির্বাচনি ব্যয় হবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার মতো। কোনোভাবেই তা এক হাজার কোটি টাকার বাইরে যাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে নির্বাচনী অর্থনীতির আকার আট হাজার কোটি টাকার বেশি। এক্ষেত্রে সব প্রার্থী সমানভাবে ব্যয় করতে পারেন না। ফলে বড় দুই জোটের প্রার্থীরা বড় অঙ্কের ব্যয় করে থাকেন। তারা কেউ কেউ ২৫ লাখের পরিবর্তে ২৫ কোটি টাকাও ব্যয় করে থাকেন।

এবারের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ৩০৬৫ জনের মধ্যে বৈধ মনোনয়নপত্র দুই হাজার ২৭৯টি এবং নির্বাচন কমিশন বাতিল করেছে ৭৮৬টি। 

সে হিসেবে শুধু জোটসহ আওয়ামী লীগ ৩০০ জন ও বিএনপির ৩০০ জন প্রার্থী মিলে মোট ৬০০ জন প্রার্থীর জনপ্রতি খরচ ৭ কোটি টাকা করে ধরলে মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা যদি ৪০০ ধরা হয়, তবে সব স্বতন্ত্র প্রার্থীর খরচের পরিমান দাঁড়াবে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ফলে জোটসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১ হাজার প্রার্থীর মোট খরচ ৭ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া মনোনয়পত্র জমা দেওয়া ৩ হাজার ৬৫ জন প্রার্থীকে শুধু মনোনয়নপত্র কিনতে খরচ করতে হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। পাশাপাশি ঢাকায় যাতায়াত ও জনসংযোগেও খরচ করতে হয়েছে তাদের। নির্বাচনি মাঠে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবেন না এমন প্রার্থীর সংখ্যা যদি ২ হাজার জন ধরি এবং এ পর্যন্ত তাদের খচর জনপ্রতি ২ লাখ টাকা করে ধরি। তবে তাদের মোট খরচ দাঁড়ায় ৪০ কোটি টাকা।

পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের সংসদীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনে ব্যয়ের জন্য সরকারের বরাদ্দ ১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে সংসদীয় নির্বাচন সম্পাদনে এরই মধ্যে কমিশন ৭০০ কোটি টাকা চেয়েছেন।

ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ব্যয়, জোটসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর খরচ, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের খরচ, মনোনয় জমা দেওয়া অথচ নির্বাচন করেননি এমন প্রার্থীদের খরচ সব মিলিয়ে এবার নির্বাচনে ৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার খরচ।

এছাড়াও একজন প্রার্থীকে নির্বাচন কমিশনে জামানত হিসেবে ৩০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। জয়ী বা জামানত ফেরতের নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট পেলে সে জামানত ফেরত পাবেন। তবে, বাকিরা এই টাকা ফেরত পাবে না। ফলে জামানতেও বড় অঙ্কের একটা খরচ হয়। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ফরম বিক্রি করে চার হাজার ২৩টি, বিএনপি চার হাজার ৫৮০টি, জাতীয় পাটি দুই হাজার ৮৬৫টি। এছাড়াও জাসদ-বাসদসহ সব দলগুলো মিলে প্রায় ১২ হাজার ফরম বিক্রি করে। এখানেও দলগুলোর ফান্ডে প্রার্থীকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দিতে হয়। আর এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। সব মিলে বলা যায়, এবারের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।  

আরকে// এসএইচ/