ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১

তিন তলা থেকে ফেলে দেওয়া এক নারীর উত্থানের গল্প  

প্রকাশিত : ০৯:১৩ পিএম, ২ ডিসেম্বর ২০১৮ রবিবার

বাংলাদেশের নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের একজন খেলোয়াড় রত্না। দশ নম্বর জার্সি পরেন তিনি। হয়তো দাঁড়িয়েই খেলতে পারতেন তিনি। কিন্তু হুইলচেয়ারে বসার পেছনে একটি গল্প আছে।   

সাভারের সিপিআর বা পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাঝামাঝি একটি জায়গায় বাস্কেটবল কোর্ট। সেখানে গিয়ে দেখা যায় চারজন সতীর্থের সাথে হাস্যোজ্বল রত্না, হুইলচেয়ার নিয়ে ছুটছেন, হাতে বাস্কেটবল।

এখন রত্না কেমন আছেন? জানতে চাইলে বলেন, "আল্লাহ এখন আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন, আমি যা চাই তাই করছি। আমার এই জীবন অনেক সুন্দর। অনেক সুস্থ মানুষ যা করতে পারেন না তাই করছি আমি অসুস্থ হয়ে।"

কিন্তু তিনি অসুস্থ হলেন কীভাবে?

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদককে বলা শুরু করলেন কীভাবে ১১ বা সাড়ে ১১ বছর বয়সে বিয়ের পর জীবন কঠিন হয়ে যায় কিশোরী রত্নার।

"আমি বিয়ে করেছিলাম ঠিকই, সংসারও করছিলাম। কিন্তু আমি এমন একজন ছিলাম, যাকে শ্বাশুড়ি পছন্দ করতেন না। কারণ আমার স্বামীর সাথে প্রেম করে বিয়ে করি আমি।"

"মনে হচ্ছিল একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার একটি সন্তানও আছে। আমার মা সবসময় বলতেন, কখনো কোথাও না যেতে, আমি যাতে সব মেনে নেই। আম্মার কথা ছিল এমন, যে সংসারে এমন টুকটাক হয়। আমিও তাই মেনে নেই," বলছিলেন রত্না কীভাবে তিনি শ্বশুরবাড়িতে বিদ্বেষ মেনে নেন।

তবে একটা সময় নির্যাতন শুরু হয় রত্নার ওপর। নিয়মিত বাসাতেই মারধোর করা হয় তার ওপর। একদিন স্বামীর বিদেশ যাওয়ার জন্য ১ লক্ষ টাকা চায় শ্বশুরবাড়ির পরিবার।

টাকার জন্য বারবার চাপ দেয়া হচ্ছিল। শ্বশুরবাড়ি তেমন সচ্ছল না হওয়ার কারণে রত্না বাবার কাছে টাকা চায়। রত্না বলেন, "আমি বাবার কাছে টাকা চাই। বাবা বলেন কিছু সময় লাগবে। বোঝেন তো, এক লাখ টাকা তো মুখের কথা না।"

তবে যত দিন যাচ্ছিল ততই মারধোরের মাত্রা বাড়ছিলো।

একদিন আবারও মারধোর শুরু করলে, রত্না মামাশ্বশুরের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানে যাওয়ার পর দেখা যায় তার নাক থেকে রক্ত পড়ছে। সাদা ওড়না লাল হয়ে যায়।

সেখানেও তার শ্বশুরবাড়ি পরিবারের লোক পিছু নিয়ে চলে আসে। রত্না সিঁড়ির ঘরে লুকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ এরপর ছাদে চলে যান, ছাদের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ান।

শ্বশুরবাড়ির পরিবারের লোকজন সজোরে ধাক্কা দেন সেখানে, মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রত্না।

এরপর বিবিসিকে রত্না এভাবে বলেন, "কথা বলার শক্তি আমার আর নাই, তবে ওরা কী বলছিল আমি শুনছিলাম।"

"ওরা বলছে খানিকক্ষণ পরে - ও কী মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে? আবার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে মারা যাইনি বেঁচে আছি। দুইজন যখন গায়ে ধরে আমাকে ফেলে দিচ্ছে তখন শুধু আল্লাহকে ডাকছি আর বলছি আল্লাহ তুমি আমাকে রহমত করো আমার একটা বাচ্চা আছে।"

সেখান থেকে এলাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রত্নাকে। জানানো হয়, স্পাইনাল কর্ড ভেঙে গিয়েছে রত্নার। যার ফলে পায়ের অনুভূতি শূন্যের কোঠায় নেমে এসে অচল হয়ে যায়।

এরপর সিআরপিতে আসেন রত্না।

এখানে আসার পরের গল্পটা রত্না বলেন এভাবে, "এখানে আসার পর শুধু কান্না পেতো। সারাদিন বসে ভাবতাম কী করা যায়। এরপর সেলাই মেশিনে কাজ শিখে ফেলি। ভেবেছিলাম গার্মেন্টেসে কাজ করবো।"

কিন্তু গার্মেন্টসে কাজ করতে পারেন না তিনি। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি ও সিআরপির তত্ত্বাবধায়নে একটি বাস্কেটবল প্রশিক্ষণ শুরু হয় সেখানে খেলা শুরু করেন রত্না।

এক পর্যায়ে দলটি দেশে ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতে খেলা শুরু করে। রত্না এখন বেশ সুখে দিন কাটাচ্ছেন। তার একমাত্র সন্তানের বয়স এখন ৮ বছর।

রত্না বলেন, সন্তানকে অনেক দিন তার থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। কারণ ভাবা হচ্ছিল সন্তান জবানবন্দী দিয়ে দিলে ওদের ক্ষতি হবে। ছয় মাস হলো সন্তান তার কাছেই থাকে। সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসি