সুবিধাবঞ্চিতদের মুখে হাসি দেখতে চায় বেটার ট্যুমরো
হাবিপ্রবি সংবাদদাতা
প্রকাশিত : ১২:৫২ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৩:১৮ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার
ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রতিযোগিতার যুগে মানুষ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্যস্ত নগরের মানুষেরা কেউ যেন কারও নয়, কেউ কাউকে চেনে না। সবাই নিজের ভাবনায় ব্যস্ত। সমাজের অবহেলিত নিপীড়িত সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে ভাববার যেন ফুসরত হয়ে ওঠে না।
তবে পৃথিবীতে সেই মানুষগুলোই সবচেয়ে সুখের কাছাকাছি যেতে পেরেছে, যারা নিজেদেরকে আর্তমানবতার সেবায় বিলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। নিজের জন্য নয় সমাজ ও মানুষের সেবা করার মাঝেই সবচেয়ে বড় আনন্দ পেয়েছে। যারা উপলব্ধি করতে পেরেছে ভোগের মাঝে সুখ নেই ত্যাগের মধ্যেই সব সুখ। তারাই সত্যিকারের আনন্দ খুঁজে পেয়েছে পৃথীবীতে। আর সে আনন্দ আর সুখ আহরণ করতে পৃথীবিতে গড়ে ওঠেছে নানা ধরণের সামাজিক সেবামূলক সংগঠন। ভালো কোনও কাজ করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন উদ্যোগের। সময় নেই, টাকা নেই, মন ভালো নেই, এমন যতই অজুহাত থাকুক না কেন ইচ্ছাশক্তি থাকলে ভালো কিছু করা অবশ্যই সম্ভব। এই ইচ্ছাশক্তিটি যদি কয়েকজন তরুণ-তরুণীর মাঝে একযোগে জেগে উঠে তাহলে তো কথাই নেই। একঝাঁক তরুণ-তরুণীর ইচ্ছাশক্তির কাছে সব অসম্ভবই সম্ভব। তেমনি সুইডেনে অবস্থানরত বাংলাদেশি কিছু তরুণদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা একটি অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন হলো বেটার ট্যুমরো সুইডেন।
২০১০ সালে গোলাম কিবরিয়া (প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি) তানভীর তৌহিদ (বর্তমান সভাপতি), তাওহিদুল আলম (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক), তৌহিদুল ইসলাম (সদস্য), তুহিন সরকার (সদস্য), শাহনেওয়াজ ইসলাম (সদস্য) ও তানবীর আলম (সদস্য) নামের ৭ তরুণের হাত ধরে এর কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১২ সালে এটি সুইডেনের রাজধানী স্টোকহোম থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এবং অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুইডিশ ট্যাক্স কর্তৃক নিবন্ধিত হয়।
এর পূর্ব থেকেই সংগঠনটি সমাজের অবহেলিত, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এগিয়ে নিতে কাজ করে শুরু করেছিল। শিক্ষা সহায়তা, আর্থিক সহায়তা, জরুরী সেবা এবং সবার জন্য হাসি এই চার মূলনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণদের এই সামাজিক সেবামূলক সংগঠনটি।
বেটার ট্যুমরো মনে করে টেকসই উন্নয়নের জন্য সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়কে এগিয়ে আনতে হবে। পৃথীবিতে হাজারেরও বেশি পরিবার আছে যারা প্রতিনিয়ত দৈনন্দিন জীবনের জন্য খাদ্যের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এমন কিছু সম্প্রদায় আছে, যারা লেখা-পড়া করতে স্কুলে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায় না। অনেক পরিবার এমনও আছে যাদের চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য নেই। অনেক সময় হঠাৎ করে কোনও দুর্ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে অনেক ভাল পরিবারও বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পতিত হয়। তাদের আশা-ভরসার সারথী হয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটানোর লক্ষ্যে আমাদের এই উদ্যোগ, যাতে করে তারা সমাজে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
শিক্ষা সহায়তা
শিক্ষা হলো একটি রাস্তা যেটি মানুষকে তার জীবনে কি প্রয়োজন তা বুঝাতে শেখায়। এ কারণে আমরা সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাড়াতে আগ্রহী। যাতে সে শিক্ষা এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। আমাদের এই অল্প সময়ে আমরা ইতোমধ্যে দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে সাহায্য করতে পেরেছি। যারা আজ নিজের পায়ে দাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
আর্থিক সহায়তা
বেটার ট্যুমরো মনে করে অল্প করে অনেক মানুষকে সহায়তা করার চেয়ে একজন মানুষকে ভালো পরিমাণ কিছু অর্থ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করে থাকি। যাতে করে সে ছোট খাট ব্যবসা শুরু করতে পারে। হতে পারে সেটা মুদি দোকান, কিংবা কোন ফার্ম (হাস-মুরগী,গরু,সবজি ফার্ম) ইত্যাদিও হতে পারে। আমরা এ রকম কিছু মানুষকে সহায়তা করেছি যারা আত্মনির্ভর হয়ে ওঠেছে। এছাড়া আমরা কিছু মানুষকে গাড়ি, ভ্যান, অটো কিনে দিয়েছি।
জরুরি সেবা
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটানায় যারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের জরুরি সেবা প্রদানের জন্য আমরা কাজ করে থাকি। মানসিক সস্থি দানের পাশাপাশি আমরা তাদের জন্য আবাসন সুবিধা প্রদানের জন্য চেষ্টা করে থাকি। শুধু দুর্যোগকালীন সাময়িক সহযোগিতা দানে সীমাবদ্ধ থাকি না।
সবার জন্য হাসি
বেটার ট্যুমরো মনে করে ধনী –গরীব সবারই জীবনকে উপভোগ করার অধিকার আছে। ধনীরা হয়তো উৎসবের দিনগুলোতে উত্তম পোশাক, উত্তম খাবারে নিজেকে সজ্জিত করে। সেখানে সুবিধাবঞ্চিত অনেক মানুষ আছে যারা পড়নের কাপড় কিংবা একমুঠো খাবার জোগাতে অনেক বেগ পেতে হয়। আমরা সেই অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা যাতে তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে নতুন পোশাক, খাবার এর আনন্দ আস্বাদন করতে সে জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
সংগঠনের গত বছরের ছোট একটি পরিসংখ্যান-
ক্যারিয়ার সেমিনার
আমরা অভিবাসী সুইডিশদের নিয়ে ক্যারিয়ার সেমিনার করেছি। সেখানে পেশাগত অভিজ্ঞতা আমরা আলোচনা করেছি। যেটা নতুন এই কমিউনিটিতে আসছে তাদের সামনের চলার পাথেয় হিসাবে কাজ করবে। নতুন পরিবেশে অনেকে অনেক বিষয় বুঝে উঠতে পারে না। শুরুতে এমন গাইড লাইন পেলে তাদের পেশাগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রোহিঙ্গা প্রকল্প
যারা মায়ানমার থেকে নির্বাসিত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আমরা তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে গিয়েছি আমাদের এই ক্ষুদ্র সংগঠন থেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা জেনেছি বাংলাদেশে ৭ লাখের বেশি মায়ানমার অভিবাসী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা শুনেছি তাদের করুণ নির্বাসিত হওয়ার কাহিনী। হঠাৎ করে এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের যেমন থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয় দরকার ঠিক তেমনি তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, টয়লেট, বাথরুমেরও প্রয়োজন। এ সব ব্যবস্থা না করা হলে দূষিত হতে পারে পরিবেশ। বাড়তে পারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও মৃত্যুহার। এ সব বিষয়ে আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের এই সংগঠন থেকে কাজ করেছি। আমরা তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করার পাশাপাশি ১৪টি টয়লেট এবং বাথরুম করে দিয়েছি। যেখানে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। যাদের কথা না বললেই নয় তারা হলেন, আব্দুল মান্নান, নাহিদ হাসান, হাবীব, রাসেল রাজু। এছাড়াও ছিল আমাদের সংগঠনের একজন কর্মী নাজমুল হুদা লালন।
বন্যাকালীন ত্রাণ বিতরণ
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ অঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেই অন্তিম মুহূর্তগুলোতে বাড়ি বাড়ি খাবার, ওষধ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
সেবা প্রকল্প
আমরা ২০১৭ তেই সুবিধাবঞ্চিত ১০০ টি বেশি পরিবারের মাঝে হাসের বাচ্চা বিতরণ করেছি। এবং তাদের লালন পালনের জন্য ওয়ার্কশপ করেছি। সেগুলো এখন ডিম দিচ্ছে। আমরা মনে করি দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য সুবিধাবঞ্চিতদের এগিয়ে আনতে হবে। তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে উন্নত হবে দেশ ও জাতি।
দক্ষতা বৃদ্ধি প্রকল্প
আমরা বাংলাদেশের ৩ টি জায়গায় ৪৫ জনকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এবং তাদের মাঝে সেলাই মেশিনও প্রদান করেছি। তারা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অনেকে এখন দর্জি হিসাবে কাজ করেছে সাবলম্বী হয়ে উঠছে।
গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি
গ্রামীণ নারীদের দক্ষ এবং সামাজিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। তাদের একটি সমবায়ের মধ্যে নিয়ে এসে গরু –ছাগল, হাস-মুরগি পালনের জন্য আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছি।
উপরের এ সব কথা বলছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ৬ষ্ঠ ব্যাচের ছাত্র গোলাম কিবরিয়া। তিনি এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে সংগঠনের বোর্ড মেম্বার ও প্রকল্প সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।