ঢাকা, রবিবার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৬ ১৪৩১

একজন আনোয়ার হোসেনের কথা 

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৬:২৮ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৯:১০ পিএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার

বাংলাদেশের সিনেমাটোগ্রাফির জগতে আনোয়ার হোসেন অন্যতম একটি নাম। সিনেমাটোগ্রাফির কথা আসলে সর্বপ্রথম তার নামটিই সবার মানসপটে ভেসে উঠে। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র মধ্য দিয়ে সিনেমাটোগ্রাফির জগতে প্রবেশ করে সাফল্যের চূড়ায় উঠেছিলেন আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সিনেমাটোগ্রাফির ভাষার নান্দনিকতাবোধ সম্ভবত তার হাত ধরেই রচিত হয়েছিল।        

কিংবদন্তি এই সিনেমাটোগ্রাফারের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৬ অক্টোবর পুরান ঢাকায়। আরমানিটোলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় শিক্ষা বোর্ডে তৃতীয় হয়েছিলেন। এরপর নটর ডেম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে। সেখানেও ভালো ফলাফল করেন। তবে একসময় সিনেমাটোগ্রাফি’র উপর পড়াশোনা করতে পাড়ি জমান ভারতে। ১৯৬৭ সালে আলোকচিত্রের জীবন শুরু করেন আনোয়ার হোসেন।

আনোয়ার হোসেন পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। এরপর তিনি বাবুল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, সিবি জামানের ‘পুরস্কার’, নিয়ামত আলীর ‘দহন’, অন্য জীবন, তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালসালু’, ‘শ্যামলছায়া’র মতো ছবির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন। অসম্ভব প্রতিভাধর এই শিল্পী কমনওয়েলথ গোল্ড মেডেলসহ ৬৮টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।   

আনোয়ার হোসেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র যুগল পরিচালকের একজন মসিউদ্দীন শাকের। তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘আনোয়ার আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিলেন। ষাট এর দশকে আমরা বুয়েটে স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হই। আমার দুই বছর পরই একই বিভাগে ভর্তি হন অনোয়ার। দেখতাম সে সব সময় ফটোগ্রাফিতে মেতে থাকতো। শহর বা গ্রামে গিয়ে নানা ধরনের ছবি তুলে সে আমাদের দেখাতো। এটা খুব ভালো লাগতো। পরে আমরা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরু করলে আনোয়ারকে সেখানে যুক্ত করি। এরপর ওই সময় পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে বৃত্তির ঘোষণা এল। এর আগে সেখানে বাদল রহমান, সালাউদ্দীন জ্যাকি তারাও পড়েছে। তখন আমি তাকে পুনেতে পড়াশোনা করার জন্য বললাম। সে কথা মতো তাই করেছিল। ’

মসিউদ্দীন শাকের বলেন, ‘ছয় বছর পর আমরা যখন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’নির্মাণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন আনোয়ারকে চিঠি লিখলাম তুমি দেশে চলে এসো। সে কথা মতো চলে এলো। তারপর কাজ শুরু করলাম। দেখা গেল ফটোগ্রাফির জ্ঞান আর সিনেমাটোগ্রাফির ওপর পড়াশোনা দুই-ই মিলিয়ে আনোয়ার চমৎকার কাজ করলেন। এমন অনেক বিষয় ছিল, যেগুলো অন্য কেউ হলে অনেকক্ষণ বুঝিয়ে বলতে হতো। কিন্তু তাকে বোঝানোর দরকার হয়নি।’  

আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই পরিচয় ঘটে ডলি আনোয়ারের। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র সেট থেকে যে প্রেম তাদের শুরু হয় একসময় এক সন্তানের মা ডলিকে বিয়ে করেন আনোয়ার। কিন্তু ১৯৯১ সালে ডলি আত্মহত্যা করলে আনোয়ার হোসেনের জীবন বিষাদে চেয়ে যায়। তারপর ১৯৯৫ সালে ফ্রান্সে পাড়ি জমান এই কীর্তিমান। সেখানে ১৯৯৬ সালে ফরাসি মেয়ে মারিয়ামকে বিয়ে করে আবারও নতুন জীবন শুরু করেন। বর্তমানে আকাশ হোসেন ও মেঘদূত হোসেন নামে আনোয়ার হোসেনের দুই পুত্র সন্তান রয়েছে।

আনোয়ার হোসেন ভালোবাসতেন নির্জনতা। ৭০ বছর বয়সে তিনি ঘুরে বেড়াতেন বন-বাদাড়ে। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। ফ্রান্সে কিছুদিন থাকলেও বাকি দিনগুলো তিনি কাটাতেন গ্রামের বাড়িতে। দুই বছর আগে এই কিংবদন্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল- তিনি বলেছিলেন, গ্রামের ওই মেঠো পথ, বন-জঙ্গল আমার কাছে বেশি ভালো লাগে। কিছু শিখতে চাইলে ওখানে চলে আসিস। আমি তোদের অপেক্ষায় থাকবো.......আনোয়ার হোসেনের অপেক্ষা আর শেষ হবে না। তিনি নিরবে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শনিবার ১ ডিসেম্বর তার নিরব প্রস্থান ঘটে। বিদায় ঘটে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের।

এসি