স্মরণ
নুর আহমেদ ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু
প্রকাশিত : ০২:৪৭ পিএম, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১১:৪৫ এএম, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮ শনিবার
মৃত্যু মানুষের জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হলেও কিছু কিছু মৃত্যু আপনজনদের দারুণভাবে নাড়া দেয়। মৃত্যুবরণকারী যদি রাজনৈতিক নেতা হন, তাহলে তা শুধু পরিবার-পরিজনে সীমিত থাকে না- তার ঢেউ দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মনেও লাগে। হঠাৎ করে যে ত্যাগী রাজনীতিকের জীবন প্রদীপ নিভে গেলো তিনি হলেন-শ্রমজীবী মানুষের বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল নেতা, গরীব-দুঃখী মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, একসময়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে (সীতাকুণ্ড বাকশালের সাধারণ সম্পাদক) আমার অগ্রজ সহযোদ্ধা ও অভিভাবক, সীতাকুণ্ডের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক,বীরমুক্তিযোদ্ধা নুর আহমেদ (৮০)। গত ৫ডিসেম্বর সকালে তিনি চমেক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৪ মেয়ে ২ ছেলেসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মৃত্যুর দিন বিকেলে সীতাকুণ্ড সরকারি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে প্রথম নামাজে জানাজা ও সন্ধ্যায় নিজগ্রাম সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের গুলিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজাশেষে পারিবারিবারিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয়মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর আহমেদকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর আগে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য আ ম ম দিলসাদের সঞ্চালনায় মরহুম নুর আহমেদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ওপর আলোকপাত করে বক্তৃতা করেন স্থানীয় এমপি দিদারুল আলম, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম, সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া, সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এস আল মামুন, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন রায়, সীতাকুণ্ড উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলীম উল্রাহ ও মরহুম নুর আহমেদের ছোটভাই সৌদি আরব প্রবাসী সাংবাদিক ইউছুফ খান।
শ্রমিকনেতা নুর আহমেদ, আমাদের সবার প্রিয় নুর আহমেদ। সীতাকুণ্ডের এক সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন তিনি। সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক-কর্মচারিদের যিনি ছিলেন অত্যন্ত আপনজন ও সুখ-দুঃখের সাথী। শ্রমজীবী মানুষের এ প্রিয় নেতাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে এরশাদ সরকারের আমলে শ্রমিক-জনতা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলসড়ক অবরোধ তৈরি করে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিলে তখনকার শাসকগোষ্ঠী তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বাড়বকুণ্ডের প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ (যেখানে তিনি চাকরি করতেন) থেকে শুরু করে সীতাকুণ্ড সদরের বর্ণালী ক্লাব ও সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের কাকার মালিকানাধীন ইউনাইটেড ফার্মেসির দোতলায় ছিল তার বসারস্থান। শিল্প-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নানা সমস্যা নিয়ে নুর আহমেদ ভাইয়ের কাছে ছুটে আসতো। মনোযোগ সহকারে তিনি সবার কথা শোনতেন এবং সাধ্যমতো তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। তার মধ্যে কোনও ছলচাতুরি ছিল না, ছিল না কোনও ভণ্ডামি। অত্যন্ত সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও আদর্শবান নেতা ছিলেন তিনি। নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন বরাবরই আপোসহীন ও অটল। ১৯৮৮ সালে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করার কথা। কিন্তু কেন্দ্রবন্ধ করে জালভোট দ্বারা প্রতিপক্ষ শাসকদল সমর্থিত প্রার্থী তাকে পরাজিত করে। একইভাবে ভোট নেওয়ার তারও শক্তি-সামর্থ সবই ছিল কিন্তু তিনি অনিয়মের আশ্রয় নেননি। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘দু’নম্বরী করে আমার উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার কোনও দরকার নেই।’
স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনসহ রাজনীতির কঠিন সময়ে নুর আহমেদভাই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি ছিলেন সীতাকুণ্ড বাকশালের সাধারণ সম্পাদক। তারই নেতৃত্বে সৈয়দপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ও আমি (মোহাম্মদ ইউসুফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সীতাকুণ্ড উপজেলা জাতীয় ছাত্রলীগ) বাকশালকে সীতাকুণ্ডে সাংগঠনিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যাপক শ্রম-মেধা ব্যয় করেছিলাম।সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কর্তৃক বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে আমাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।রাজনীতির এ দুঃসময়ে নুর আহমেদভাই ছিলেন আমাদের ছায়ার মতো। দলীয় নেতা-কর্মীদের সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সংগ্রামী চেতনা ও অসীম সাহস আমাদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করতো। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ও বাকশাল একিভূত হওয়ায় রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে যায়।
কাছ থেকে দেখা সহজ-সরল এ মানুষটি আগাগোড়াই ছিলেন রাজনীতিক। চট্টগ্রাম অঞ্চলে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়সহ প্রতিটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নিজ বিত্তবৈভবের কথা চিন্তা না করে জীবনের বেশিরভাগ সময় রাজনীতির জন্যে ব্যয় করেছেন; মানুষের জন্যে কাজ করেছেন। ভোগের চেয়ে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে তিনি গণমানুষের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ত্যাগের মহিমায় তিনি ভাস্বর হয়ে ওঠেছিলেন। জীবনের শেষসময়ে এসে অসুস্থ রাজনীতির হিসাব নিকাশ মেলাতে না পেরে তিনি মানসিক যাতনায় ভোগতেন। নিজের মতো করে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করতে না পেরে চরম হতাশার কথা ব্যক্ত করতেন রাজনৈতিক সতীর্থদের কাছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার যৌক্তিক পরিণতি না ঘটলেও মৃত্যুর একদিন আগেও মধ্যরাত পর্যন্ত দলীয় নেতাদের নিয়ে সীতাকুণ্ডের আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পরদিন সকালে হঠাৎ হার্টস্ট্রোক করে দলীয় নেতা-কর্মী ও পরিবারের সদস্যদের শোকসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চিরতরে বিদায় নিলেন।
পরিশেষে প্রয়াত নুর আহমেদভাইয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখকঃ প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী