শিশুর সকালের নাস্তা ও স্কুলের টিফিন কেমন হবে?
সোনিয়া শরমিন খান
প্রকাশিত : ০৬:৩০ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:১১ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
লেখকঃ সোনিয়া শরমিন খান
আমার বড় ছেলের বয়স ৮ বছর। রাজধানীর একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। মা হিসেবে সবসময় গুরুত্ব দেই ছেলের সকালের নাস্তা এবং স্কুলের টিফিনের ব্যাপারে। এটা খুবই যন্ত্রণা দায়ক বিষয় আমার মত প্রায় সব মায়েদেরই। কারণ সবার ই অভিযোগ হলো আমার বাচ্চা সকালে কিছুই খেতে চায় না। খুব কম খায় বা খায় ই না। আর টিফিনে চিকেন ফ্রাই, বার্গার, সসেজ, চিকেন বল, সমুসা, সিংগাড়া ইত্যাদি ফ্রায়েড বা ভাজা খাবারই শিশুদের পছন্দের শীর্ষে।
মূলতঃ শিশুদের স্কুল জীবন শুরু হতেই এই সমস্যা একটু একটু করে বাড়তে থাকে এবং স্থায়ীভাবে শিশুদের পছন্দের খাবার হয়ে যায় ভাজাপোড়া খাবার গুলোই। মাতৃত্বের দূর্বলতায় আমরা প্রায়শই নিজেদের অজান্তেই সন্তানদের পছন্দের দাম দিতে গিয়ে তাদের ক্ষতি করে ফেলছি।
আমি আমার সব ধরনের লেখাতেই ব্যাক্তির ক্যালরির চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েছি। শিশুরাও এর ব্যাতিক্রম নয়। শিশুদের বয়স, ওজন, উচ্চতা এবং পরিশ্রম বা এক্টিভিটির প্রকার ভেদে ক্যালরির চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। সাধারনত শিশুদের ৪/৫ বছর বয়স থেকে ১৪/১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বয়স, ওজন, উচ্চতা, লিংগ এবং পরিশ্রম বা এক্টিভিটির প্রকার অনুযায়ী ক্যালরির চাহিদা হয় ১০০০ ক্যালরি থেকে ১৮০০ ক্যালরি পর্যন্ত। আর এই ক্যালরির কিছু কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার থেকে, কিছু প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে এবং কিছু ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করতে হয়। তাছাড়াও সব পুষ্টি উপাদান এর সমন্বয় রেখে ভিটামিন,মিনারেলস এর চাহিদা মিটিয়ে এই নির্দিষ্ট ক্যালরিবহুল খাদ্য তালিকা বা ডায়েট চার্ট পরিকল্পনা করতে হয়।
প্রথমত, শিশুর জন্য সকালের সঠিক নাস্তা নির্বাচনের বিষয়ে কিছুটা ধারনা দেই। শিশুর নাস্তা টা তার সারাদিনের প্রথম খাবার। আর পুষ্টিবিদ হিসাবে আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং এনালাইসিস থেকে দেখেছি দিনের প্রথম খাবার টি প্রোটিন জাতীয় খাবার দিয়ে শুরু করা উচিত। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি ডিম হতে পারে খুব আদর্শ খাবার। তবে হ্যা, শিশুরা সকালে ডিম খেতে চায় না বা বমির ভাব হয়,এমন কথা প্রায়ই শুনি। এক্ষেত্রে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে মেন্যু ও রেসিপি পরিকল্পনা করা যায়। যেমন, ডিম ও দুধের পুডিং বানিয়ে খাওয়ানো যায়। কিছু জরুরী ভিটামিনস ও মিনারেলস এর চাহিদা মেটাতে এই পুডিং এ কয়েকটা বাদাম গুড়ো করে মিশিয়ে দিলে স্বাদ বর্ধনের পাশাপাশি পুষ্টির সরবরাহও নিশ্চিত করা যায়। এছাড়াও ডিম কে একটু অন্যভাবে কর্ন ফ্লাওয়ার বা সাগু দিয়ে স্যুপ রান্না বা কিছু সবজি ও মাংস দিয়ে ভেজে দেয়া যায়। সকালের কার্বোহাইড্রেট এর ক্যালরিটা আসবে অবশ্যই রুটি / পাউরুটি / পরোটা অথবা সুজি / সাগু /ওটস / কর্নফ্লেক্স থেকে। হ্যা এটাও ঠিক অনেক শিশু তো রুটি, পরোটা পছন্দই করে না। এক্ষেত্রে রুটি বা পরোটা কে শিশুর জন্য একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
যেমনঃ রুটি বা পরোটায় ঘরে তৈরি টমেটোর সস এবং মেয়নিজ লাগিয়ে তাতে কিছু মাংসের কুচি ও সবজি কুচি দিয়ে রোল করে দিয়ে অথবা পাউরুটিতে ঘরে তৈরি টমেটো সস এবং চিজ/ মেয়নিজ দিয়ে ডিমে ডুবিয়ে ভেজে বা এর ভেতর অন্যান্য সবজি ও মাংস দিয়ে স্যান্ডউইচ করে দিলে শিশুদের পছন্দের খাবারের সমতুল্য এবং উপাদেয় অথচ সঠিক পুষ্টির সরবরাহ করে ক্যালরির চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।
এখন আসি শিশুকে টিফিনে কি দিব? স্কুলের সময় টা খুব সকালে হওয়ায় শিশুর নাস্তা খাওয়ার পরিমাণ টা সাধারণত কম হয়ে যায়। তাই সকালের খাবারটা যতটা সম্ভব শর্টকাট বা ছোট করে, নাস্তার জন্য নির্দিষ্ট খাবারকেই টিফিনে দেয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য, শিশুর টিফিনের খাবারে কিছু ফল যুক্ত করা অত্যাবশ্যক। কারন ফল খাওয়ার উপযুক্ত সময় হলো মধ্যসকালের সময় টি, যেটা সাধারণত টিফিনের সময়টিতেই অন্তর্ভুক্ত। তাই কয়েক টুকরো আপেল / নাশপাতি / পেয়ারা / কমলা / মাল্টা / পাকা পেপে / বড়ই / আমড়া / তরমুজ / বেদানা অথবা একটি ছোট কলা শিশুর টিফিনে সংযুক্তিতে একাধারে তার দেহে পুষ্টি সরবরাহ এবং পুষ্টি উপাদানের শোষনও নিশ্চিত হয়।
মায়েদের মনে রাখতে হবে, শিশুকে খাওয়াতে যেন কোন একটি নির্দিষ্ট খাবার অতিরিক্ত দিয়ে না দেন। বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার। কারন এই তিন ধরনের খাবার এর যেকোনো টির বাড়তি গ্রহনে, দেহের চাহিদা মেটানোর পর "বাড়তি" টুকু দেহের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অংগে চর্বি বা ফ্যাট এ পরিনত হয়। যা পরর্তীতে শিশুর ওজনাধিক্য সহ নানাবিধ অসুস্থতা সৃষ্টি করে।
তাই ভালোবেসে দুই টুকরো মাংস বেশি দিয়ে নিজের অলক্ষ্যে শিশুর ক্ষতি না করে তার চাহিদামত খাবার দেবার অভ্যাস করতে হবে। শিশুর খাবারে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা অথবা শিশুকে দোকানের কেনা ভাজা মাংস বা অন্যান্য খাবার যতটা সম্ভব না দেয়া, ফল ও সবজি কেনার সময় তা কতটা বিশুদ্ধ এবং অর্গানিক সেই বিষয়ে খেয়াল রাখা, শিশুকে দেশিয় খাবার বিশেষ করে সবজি, ফল ও মাছের সাথে পরিচিত করানো এবং খাওয়ার অভ্যাস করা, সর্বোপরি শিশুকে শারীরিক পরিশ্রম বা বিভিন্ন এক্টিভিটি (দৌড়ানো, সাতার, সাইকেল চালানো, কারাতে, রক ক্লাইম্বিং, বিভিন্ন খেলাধুলা ইত্যাদি) তে আগ্রহী করতে উৎসাহ দিতে হবে।
লেখকঃ সোনিয়া শরমিন খান
নিউট্রিশনিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান
সিটি হেলথ সার্ভিসেস লিমিটেড।
টিআর/