ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৪ ১৪৩১

সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে জাতীয় পার্টির ইশতেহার ঘোষণা

প্রকাশিত : ০৫:১২ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ শুক্রবার

সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশ করেছে জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যানের বিশেষ সহকারী ও সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এ ইশতেহার ঘোষণা করেন।     

শুক্রবার (১৪ ডিসেম্বর) বনানীতে দলটির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ১৮ দফা কর্মসূচি নিম্নরূপ:       
 
১. প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন: দেশের এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। দেশে বিদ্যমান ৮টি বিভাগকে ৮টি প্রদেশে উন্নীত করা হবে। ৮টি প্রদেশের নাম হবে (১) উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, (২) বরেণ্য প্রদেশ, (৩) জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, (৪) জালালাবাদ প্রদেশ, (৫) জাহানাবাদ প্রদেশ (৬) চন্দ্রদীপ প্রদেশ, (৭) ময়নামতি প্রদেশ এবং (৮) চট্টলা প্রদেশ।
দুই স্তরবিশিষ্ট সরকার কাঠামো থাকবে। (১) কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডারেল সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারে থাকবে ৩০০ আসনবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ এবং (২) প্রাদেশিক সরকার। প্রাদেশিক সরকারের থাকবে প্রাদেশিক সংসদ। প্রতি উপজেলা কিংবা থানাকে প্রাদেশিক সরকারের এক একটি আসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। যদিও এটা দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কারের বিষয়, তথাপিও আমরা মনে করি- পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে প্রাদেশিক ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব (প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কিত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রণিত একটি দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত পুস্তিকায় বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে।) ঢাকা শহর থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদর দফতর প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থানান্তর করা হবে।  

২. নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার: নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করে আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করা হবে। নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেওয়া হবে। সন্ত্রাস, অস্ত্র ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে হয়তো সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সময় লাগবে।

৩. পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন: উপজেলা আদালত ও পারিবারিক আদালতসহ পূর্ণাঙ্গ উপজেলা ব্যবস্থা চালু করা হবে। স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করে এবং নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে উপজেলার ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

৪.বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেওয়া হবে। জাতীয় পার্টি সুযোগ পেলে এক বছর সময়ের মধ্যে এটা নিশ্চিত করা হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে মামলার জট শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করার প্রবণতা বন্ধ করা হবে। প্রাদেশিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে প্রত্যেক প্রাদেশিক রাজধানীতে হাইকোর্টের বেঞ্চ বসানো হবে।

৫. ধর্মীয় মূল্যবোধ: ধর্মীয় মূল্যবোধকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হবে। মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ সব ধর্মীয় উপসনালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির বিল মওকুফ করে দেওয়া হবে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে প্রথমেই এ ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া হবে এবং এক বছরের মধ্যে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হবে।

৬. কৃষকের কল্যাণ সাধন: কৃষকদের ভর্তুকি মূল্যে সার, ডিজেল, কীটনাশক সরবরাহ করা হবে।
কৃষি উপকরণের কর-শুল্ক মওকুফ করা হবে। কৃষকদের বিরুদ্ধে কোনও সার্টিফিকেট মামলা হবে না। সহজ শর্তে কৃষিঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

৭. সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা: সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি দমনে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করা হবে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তিন মাসের মধ্যে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি নির্মূল করা হবে।
হত্যা-খুন-গুম-ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ করা হবে।  

৮. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ: গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি স্থিতিশীল রাখা হবে। সারা দেশে পর্যায়ক্রমে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে এবং প্রত্যেক উপজেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হবে। উত্তরবঙ্গে শিল্পায়নের ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মঙ্গা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়া হবে। উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে মঙ্গার আগ্রাসন। এই অঞ্চলের মানুষ বছরের তিন মাস কাজের সুযোগ পায় বাকি নয় মাস বেকার থাকে। ফলে সেখানে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ অবস্থা। স্থানীয়ভাবে সেটাকেই বলে মঙ্গা। এই মঙ্গা দূর করতে মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা হবে। দেশের অনগ্রসর অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

৯. ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না: একমাত্র জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় শিল্প প্রতিষ্ঠা ছাড়া কৃষি জমি বা ফসলি জমি নষ্ট করে কোনও স্থাপনা কিংবা আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা আইন করে বন্ধ করা হবে।

১০. খাদ্য নিরাপত্তা: খাদ্যে ভেজাল কিংবা খাদ্যে বিষাক্ত পদার্থ মেশানোর বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হবে।

১১. শিক্ষা পদ্ধতির সংশোধন: শিক্ষা পদ্ধতি সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের টিউশন নির্ভরতা কমানো হবে এবং কোচিং ব্যবসা বন্ধ করা হবে। সুলভ মূল্যে শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা হবে।
নিবন্ধনকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন সরকারি শিক্ষকদের সমতুল্য করা হবে। এই কর্মসূচিও এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। দেশে একটি স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত নারী শিক্ষা অবৈতনিক করা হবে। নারীদের সচেতন করে তুলতে এবং নারীদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে এক বছরের মধ্যে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত নারী শিক্ষা অবৈতনিক করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। দেশে সুষমভাবে শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে রংপুরে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় এবং রংপুরে শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করা হবে।

১২. স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ: ইউনিয়নভিত্তিক সেবাখাত উন্নত করা হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। প্রতি ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা হবে।

১৩. শান্তি ও সহাবস্থানের রাজনীতি প্রবর্তন: হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক এবং জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হবে।
শান্তি ও সহাবস্থানের রাজনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে সত্যিকার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো হবে।

১৪. সড়ক নিরাপত্তা: সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে সব রাস্তাঘাট সংস্কার করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোকে কমপক্ষে ৫০ ভাগ প্রশস্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সেই সঙ্গে সড়ক বিভাজক (ডিভাইডার) নির্মাণ করা হবে।

১৫. গুচ্ছগ্রাম পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা: গুচ্ছগ্রাম, পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। জাতীয় পার্টি শাসনামলে যেসব গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেগুলো আদর্শ গ্রামে, গুচ্ছগ্রামে উন্নীত করা হবে। গত ২৫ বছরে অভাবের তাড়নায় কিংবা নদীভাঙনে লাখো লাখো মানুষ ছিন্নমূল হয়ে পড়েছে। ফলে ঢাকা শহরে বাড়ছে ভাসমান মানুষের ভিড়। তাদের গুচ্ছগ্রামে একটা ঠিকানা দেওয়া হবে।

১৬. পল্লি রেশনিং চালু করা হবে: পল্লি অঞ্চলের মানুষের ন্যূনতম অন্নের সংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পল্লি অঞ্চলে পল্লি রেশনিং চালু করা হবে। এক বছরের মধ্যে পল্লি রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের কাছে রেশনিং ব্যবস্থায় চাল-ডাল-তেল-চিনি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে গ্রামের মানুষ নিয়মিতভাবে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে।

১৭. শিল্প ও অর্থনীতির অগ্রগতি সাধন: দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের অঞ্চলে অঞ্চলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। শিল্প ঋণ সহজলভ্য এবং নতুন শিল্প স্থাপন করা হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের দেশে অর্থ প্রেরণকে উৎসাহিত করা হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে এবং পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে এনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।  

১৮. ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা: সাধারণ নির্বাচন বাদে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত করা হবে। সেক্ষেত্রে সংসদের মোট আসন সংখ্যা হবে ৩৮০। এজন্য সংবিধানে সংশোধনী আনা হবে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যার হার অনুসারে তাদের চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে।

ইশতেহার ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য দেলোয়ার হোসেন খান, এস এম ফয়সল চিশতী, ভাইস চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান খান, আলমগীর সিকদার লোটন, যুগ্ম মহাসচিব মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, শেখ আলমগীর হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল্লাহ শফি, ফখরুল আহসান শাহজাদা, মোস্তাফিজুর রহমান নাঈম, হেলাল উদ্দিন, একেএম আশরাফুজ্জামান খান প্রমুখ।  

এসি