বিজয়ের দিনে শহীদ
প্রকাশিত : ১১:০৫ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ রবিবার
রুহুল ইসলাম সাদী
রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার অন্তর্গত বয়রাট গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবক আ. ওয়াহাব মিয়ার সন্তান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুহুল ইসলাম (সাদী)। তিনি ১৯৫০ সালে ঝিনাইদহ জেলার কাঁচেরকোল গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মাসাধিক কাল টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত থেকেও ১৯৬৬ সালে শৈলকূপা থানার বেণীপুর হাই স্কুুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আইএসসি অধ্যয়ন শেষে তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে যোগদানের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শুরু করেন। বিমানবাহিনীর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ফ্রান্সে যান এবং সেখানে বিভিন্ন দেশের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সেরা অফিসারের বিশেষ কৃতিত্ব লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেক বাঙালি সৈনিকের মতো তার অন্তরেও দেশমাতৃকার জন্য অবদান রাখার তাগিদ অনুভব করেন। সঙ্গত কারণেই অন্যান্য বাঙালি অফিসারের সঙ্গে তাকেও পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি করা হয়। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে বন্দিশিবির থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। জন্মভূমির প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখে এক পাঞ্জাবি অফিসার বন্ধু তাকে পালানোর সুযোগ দিলে তিনি জীবন বাজি রেখে ভারত হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। তিনি নিজ এলাকা রাজবাড়ীর পাংশা থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার আ. মতিন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে ভারতের বনগ্রামে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। কুষ্টিয়া, কুমারখালীসহ আশপাশে সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর রাজবাড়ী শহরে রেলওয়ে লোকোশেডে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী বিহারি ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশ নেন। ঢাকায় যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন রাজবাড়ীতে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে রুহুল ইসলাম সাদী তার দুই সহযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলামসহ নির্মমভাবে শহীদ হন `৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। শত্রু সেনারা তাকে হত্যা শেষে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে পৈশাচিক উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। তার এক সহযোদ্ধা পাংশার বয়রাট গ্রামের রবিউল ইসলাম কুসুম মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আজও বেঁচে আছেন। রাজবাড়ী শহরের রেলওয়ে লোকোশেডে যুদ্ধক্ষেত্রের সহযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণের সহায়তায় তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে রাজবাড়ীর লক্ষ্মীকোল নামক স্থানে মসজিদের সামনে সমাহিত করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মা আমেনা খাতুনকে ২০০০/- টাকা সম্মানী পাঠিয়েছিলেন। এই শহীদের মায়ের নামে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে পেনশন বরাদ্দ ছিল ৭৫ টাকা। আমেনা খাতুন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন ৩০৫/- টাকা সোনালী ব্যাংকের কসবা মাজাইল (পাংশা) শাখা থেকে গ্রহণ করেছেন। স্বাধীনতার এই সূর্যসন্তান বাংলাদেশের মুক্তির জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। এই শহীদ পরিবার অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের সচ্ছল জীবন যাপনের নিমিত্তে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন। সেখান থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও এই শহীদ পরিবারকে কোনো সহায়তা করেনি। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে শহীদ সাদীর পরিবারকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়; কখনও পত্র মারফত, কখনও পত্র ছাড়াই। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কিছু উপহার দেওয়া হয়। দেশমাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানের বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া যোদ্ধার এই হচ্ছে মূল্যায়ন। পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত থাকা অবস্থায় রুহুল ইসলাম সাদী তার বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় একটা বাড়ি তৈরি করে দেবেন। তার বাবা-মাও আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু পুত্রের অকালমৃত্যুতে তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। বর্তমানে রুহুল ইসলাম সাদীর রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার অন্তর্গত বয়রাট গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কোনো পাকা রাস্তা নেই। এই পরিবারের সব সদস্য উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে কোনো কোটায় কেউ সুযোগ পাননি। ইতিমধ্যে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য অনেককে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়েছে। শহীদ রুহুল ইসলাম সাদীর স্মরণে রাজবাড়ীতে একটি স্থাপনার নামকরণ করে এই বীর যোদ্ধার স্মৃতিকে জাগরূক রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
লেখক : শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অনুজ
এসএ/