ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

খ্রিষ্ট জন্মোৎসব

জয়ন্ত অধিকারী

প্রকাশিত : ০১:৫১ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

যুগে যুগে অবতার বা প্রেরিতরা একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখিয়েছেন যে, মানুষ অন্তর্নিহিত শক্তিতে নিজের চেয়ে নিজে বড়; সে জন্য মানুষ মৃত্যুকে, দুঃখকে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এ বিষয়টি যদি আমরা ক্ষণে-ক্ষণে নিদারুণ স্পষ্টরূপে দেখতে না পেতাম, তা হলে ক্ষুদ্র মানুষের মধ্যে যে বিরাট রয়েছেন- এ কথা বিশ্বাস করতাম কেমন করে! মানুষের সেই বিরাটত্বকে মুক্ত করার জন্যই খ্রিষ্টের ধরাধামে আবির্ভাব।

ঈশ্বরের অপর নাম `আবিঃ` অর্থাৎ আবির্ভাবই তার স্বভাব। সৃষ্টিতে তিনি নিজেকে প্রকাশ করছেন- তা-ই তাঁর ধর্ম। জলে-স্থলে-শূন্যে তা-ই তাঁর নিরন্তর আনন্দধারা। যিশুখ্রিষ্ট ছিলেন এমনই একজন অবিনশ্বর মানবতাবাদী। আর তাই খ্রিষ্টীয় দর্শনে যে মানবতাবোধ পরিলক্ষিত হয়, তা অনন্য এবং অন্য কোনো ভাববাদী বা প্রেরিতদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। এ কারণেই বর্তমান মানবতার অবক্ষয়ের যুগে তাঁর জন্মদিন নতুন নিরিখে বিবেচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন ও জরুরি হয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান।

ঈশতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে এ বিষয়টি কমবেশি সবার কাছেই স্পষ্ট যে, খ্রিষ্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন মানুষরূপে, যেন `পুরাতন নিয়মে` যে কাজ ভয়ভীতি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্লাবন, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে সম্ভব হয়নি, তা `নতুন নিয়মে` মানুষরূপে মানুষের কাছে এসে প্রত্যক্ষভাবে সম্ভব করা যায়। সুতরাং খ্রিষ্টকে পূর্ণতায় দেখলে এ বিষয়টি দুই হাজার বছর পরে আজকের দিনেও সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক বলে অবশ্যই মনে হবে।

আমরা আজকের সমাজ ব্যবস্থায় যেসব অসঙ্গতি দেখছি, সেসব তখনও ছিল। জাত-সম্প্রদায়-বর্ণভেদ; মানুষের প্রতি মানুষের হীনম্মন্যতা, বড়র সঙ্গে ছোটর প্রতিনিয়ত সংঘাত। মানুষের সেই বড়র সঙ্গে ছোটর নিয়ত সংঘাতে যে দুঃখ জন্মাচ্ছে, সেই দুঃখ পান করছেন কে? তিনিই বড়। রাগ কাকে হত্যা করছে? চিরদিন যিনি ক্ষমা করেন, তার ওপরেই সব মার গিয়ে পড়ছে।

লোভ কার ধন হরণ করছে? যিনি শুধুই ক্ষতি স্বীকার করেন এবং তা ফিরে আসবে বলে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকেন। পাপ কাকে কাঁদাতে চায়? যার প্রেমের অবধি নেই, পাপ যে তাকেই কাঁদাচ্ছে। এ আমরা চারদিকেই প্রত্যক্ষ করছি। দুর্বৃত্ত সন্তান অন্য সবাইকে যে আঘাত দেয়; সেই আঘাত আপন মাকেই সবার চেয়ে ব্যথিত করে, তাই তো দুষ্প্রবৃত্তির পাপ এতই বিষম। অকল্যাণের দুঃখ জগতের সব দুঃখের চেয়ে বেশি। কেননা, সেই দুঃখে যিনি কাঁদছেন, তিনিই যে বড়, তিনিই যে প্রেম।

খ্রিষ্ট তাঁর প্রেম, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা ও সেবা দিয়ে জানাচ্ছেন যে, সেই পরম ব্যথিতই মানুষের ভেতরকার ঈশ্বর। ঠিক এ বিষয়টিই খ্রিষ্ট তাঁর প্রেম, ভালোবাসা, সহিষুষ্ণতা ও সেবা দিয়ে তিরোহিত করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তাঁর প্রচারে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলেছেন। বলেছেন নারীর ক্ষমতায়ন, আদিবাসী, জাতিভেদ, ধর্মীয় উগ্রতা, বাকস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কথা। ক্রুশের ওপর থেকে তিনি শিষ্য যোহনকে দেখিয়ে তাঁর মাকে বলেছিলেন, `হে নারী, ওই দেখ তোমার পুত্র।

এভাবে মার্থা, শমরীয় প্রমুখ বহু নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ আমরা বাইবেলে পাই, যা খ্রিষ্টের কার্যক্রমেরই অংশ ছিল। খ্রিষ্ট প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করেছেন নিরবধি। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি অত্যাচারী রোমান শাসকগোষ্ঠী, যাজকীয় অনাচার, যিহুদি নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার, যাতে একটি ন্যায়-ন্যায্যতানির্ভর উন্নত সমাজ গড়ে তোলা যায়।

আজকের সমাজ ব্যবস্থা বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে, ২০০০ বছর আগের তুলনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। এখন বিশ্বজুড়ে মানবতাবোধ নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস, কট্টরপন্থি ধর্মীয় মনোভাব, মানুষে-মানুষে বিদ্বেষ আজ কুরে কুরে খাচ্ছে মানব সভ্যতাকে। আজ কোথায় নেই অস্থিতিশীলতা? ইউরোপ, মার্কিন মুল্লুক, মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে আজ আমরাই এই অবিবেচনাপ্রসূত অন্ধকারাচ্ছন্ন উন্মাদনার শিকার; যার পরিণতি আমাদের এই ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা অভিবাসন। সন্ত্রাসের অমানিশা আজ আমাদেরও আক্রান্ত করে ফেলেছে।

কিন্তু যারা এ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন- সন্ত্রাস, অমানবিকতা বিস্তার করে ক্ষমতার আগ্রাসন চলে না; ঠিক তেমনি সন্ত্রাস দিয়েও সন্ত্রাস দমন করা যায় না। চাই প্রেম, ভালোবাসা, মহত্ত্বের প্রকাশ। খ্রিষ্ট এসেছিলেন সব অন্ধকার দূর করে এক জ্যোতির্ময় পতাকা নিয়ে।

কিন্তু অমানবিকতা, সন্ত্রাস, ঘৃণার বিনাশ সাধন করে যে শোষণ, বঞ্চনা, উগ্রতা, সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনের কাজ খ্রিষ্ট হাতে নিয়েছিলেন; তা আজও, আমরা যাঁরা তাঁর উত্তরসূরি, তারা তা সম্পন্ন করতে পারিনি। আমরা আজ সম্প্রদায়-সম্প্রদায় বলে অহঙ্কার করি; সত্য আর সবকিছুকে ত্যাগ করে তাকেই আশ্রয় করে থাকি। ধনের অহঙ্কার আমাদের যত বাড়ে, ধনের আড়ম্বর ততই বিস্তৃত হয়, মনুষ্যত্বের গৌরব তখন তার ততই খর্ব হয়ে যায়। কাউকে পেছনে ফেলে নয়, বরং সবাইকে নিয়ে খ্রিষ্টের যে সমাজ গঠন প্রক্রিয়া, তা এখানেই অসম্পূূর্ণ রয়ে গেছে। তাই খ্রিষ্টের জন্ম নতুন করে আজ আমাদের ভাবায়, অন্যদিকে অনুপ্রেরণাও জোগায়: `কিছু কর, সমাজটাকে বদলাও। আমি যা চেয়েছিলাম, তাই কর।` আর তাই আমরা অন্য সব সম্প্রদায়ের ওপর রাগ করে সত্যের সঙ্গে বিরোধ করব না।

আমরা খ্রিষ্টধর্মের মর্মকথা গ্রহণ করার চেষ্টা করব, খ্রিষ্টানের বিষয় বলে নয়, মানুষের বিষয় বলে। ঈশ্বরের যে প্রকাশ মানুষের মাঝে, তার মধ্যে বিশেষভাবে আপন অনুভূতি, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, সহিষুষ্ণতা ও সেবাকে ব্যাপ্ত করার প্রতিই খ্রিষ্টধর্মের লক্ষ্য। বিশ্বে তাঁর প্রকাশ সরল, কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রকাশে বিরোধ আছে। সেই মানুষের ঈশ্বর মানুষের অন্তরেই রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বিরোধেই মানুষের পাপ, তাঁর সঙ্গে যোগেই মানুষের পাপের নিবৃত্তি। মানুষের সেই বড়, নিয়ত আপনার প্রাণ উৎসর্গ করে মানুষের ছোটকে প্রাণদান করছেন। রূপকের আকারে এই সত্যই প্রতিনিয়ত খ্রিষ্টধর্মে প্রকাশিত হচ্ছে। আর এই রূপকের ওপর নির্ভর করেই খ্রিষ্ট মানুষের মন পরিবর্তনের প্রতিজ্ঞায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন।

আজ তাই খ্রিষ্টের জন্মদিন আমাদের কাছে বড়দিন। আমরাও সেই পরিবর্তনের প্রতিজ্ঞায় ঈশ্বরের বাণী নীরবে শোনা এবং ধ্যান করার চেষ্টা করি। বড়দিনকে শুধু সাজসজ্জায় সীমাবদ্ধ রেখে উদযাপন না করে মনের সঙ্গে মন মিলিয়ে রঙিন করে তোলাই আমাদের জন্য বাঞ্ছনীয় হবে।

আজ আমরা যদি উপহার দিয়ে ভরে দিই, চারদিক আলোর ঝলকানি দিয়ে সাজাই, কিন্তু একজন দরিদ্র-দীন মানুষের পাশে গিয়ে না দাঁড়াই, সেটি কখনোই কাঙ্ক্ষিত বড়দিন হবে না। বড়দিন তখনই সার্থকতায় পর্যবসিত হবে, যখন এই বড়দিনে আমাদের প্রত্যয় হবে সমস্যা দেখে ভয় পাওয়া নয়; বরং সমাধানে এগিয়ে যাওয়া; মানুষের মন পরিবর্তন করা, উন্নত সমাজ বিনির্মাণে গঠনমূলক ও সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখা।

আসুন,যিশুখ্রিষ্টের এই নতুন সমাজ বদলের প্রতিজ্ঞায় আজ আমরাও সম্পৃক্ত হই। এই বড়দিন হোক আমাদের জন্য এক নতুন পথের দিশারি।

সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।