ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

অন্য দেশের লিভার রোগীরা এদেশে চিকিৎসা নিতে আসবে: ডা. মাহতাব

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৬:৩৯ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৬:৪৫ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ বুধবার

ডা. মামুন আল মাহতাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজী বিভাগের চেয়ারম্যান। পাশাপাশি তিনি ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হসপিটালের লিভার ও গ্যাস্ট্রো-অ্যান্টারোলজি বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারভেনশনাল এন্ডোসকপিস্ট। ডা. মাহতাব লিভার বিশেষজ্ঞদের জাতীয় সংগঠন এসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার -বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভারের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য।       

সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে ডা. মামুন আল মাহতাবের একান্ত আলাপ চারিতায় উঠে আসে লিভার সুস্থ রাখার উপায়, লিভার প্রতিস্থাপন ও ফ্যাটি লিভার (লিভারে চর্বি জমা) কেন হয়, কথা বলেছেন স্টেম সেল থেরাপী সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।    

সাক্ষাতকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।    

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে বর্তমানে তিন কোটি লোক লিভার রোগে আক্রান্ত। কোন ধরনের লাইফ স্টাইল লিভারের রোগগুলোর জন্য দায়ী?     

ডা. মামুন আল মাহতাব: এখন আমাদের কাছে যেসব লিভার রোগী আসে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফ্যাটি লিভার রোগী। ফ্যাটি লিভার কেন হয়? ফ্যাটি লিভারের জন্য দায়ী হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার বেশী খাওয়া, সেই খাবার শরীরে বার্ণ হবেনা বা শোষণ হচ্ছেনা এমন লাইফ স্টাইল ফলো করা। অর্থাৎ আমরা যে পরিমাণ খাচ্ছি সেই পরিমাণ কাজ করছি না। আগে আমাদের ছেলে মেয়েরা মাঠে খেলতো, দৌঁড়াত বা সাঁতার কাটতো। মানুষ শারীরিক পরিশ্রম করতো। কিন্তু নগর জীবনের প্রভাবে এখন ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলার সুযোগ পাচ্ছে না। শারীরিক পরিশ্রম একেবারেই করছে না। শারীরিক পরিশ্রম না করলে লিভারে চর্বি জমে। বরং রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফার্স্টফুড খাওয়া হচ্ছে। কোমল পানীয়র নামে যা খাওয়া হচ্ছে তাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এতে শুধু যে লিভার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা না, বরং হার্ট, ডায়াবেটিস- এসবেও আক্রান্ত হচ্ছে।    

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ফ্যাটি লিভার আক্রান্ত হওয়া কী ভয়ের বিষয়?   

ডা. মামুন আল মাহতাব: ফ্যাটি লিভার হচ্ছে এমন একটা রোগ যেটা লিভারের অন্য যে কোন রোগের মতোই খারাপ। আমরা মনে করি `বি` ভাইরাস হলে লিভারটা শেষ, `সি` ভাইরাস হলে রক্ষা নাই। ফ্যাটি লিভার মানে লিভারে চর্বি জমেছে। অন্য কোন সমস্যা নাই। বাস্তবে কিন্তু তা না। লিভারে যদি চর্বি জমে বা ফ্যাটি লিভার হয় তাহলে কখনো কখনো লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রকৃতপক্ষে ফ্যাটি লিভার থেকে যাদের লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হয় তাদের হার `বি` ভাইরাস বা `সি` ভাইরাসের হারের চেয়ে অনেক বেশি।      

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?    

ডা. মামুন আল মাহতাব: ফ্যাটি লিভারের রোগী পেলে আমরা প্রথমে যে পরামর্শ দিই, সেটি হলো এটাকে রোগ হিসেবে চিন্তা করতে হবে। হার্টে চর্বি জমলে যেমন হার্ট এ্যাটাক হতে পারে, ব্রেনে চর্বি জমলে যেমন স্ট্রোক হতে পারে তেমনি লিভারে চর্বি জমা একটা রোগ। দ্বিতীয়ত, আমাদের লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করতে হবে। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা কম খেতে হবে। বিশেষ করে রাতে ভাত কম খাওয়া ভাল। সেটা না পারলে ভাতের পরিবর্তে রুটি খান। বাঙালি সংস্কৃতি ভাত নির্ভর। রাতে খেয়ে সাথে সাথে ঘুমাতে যাওয়া ঠিক হবে না। ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ঘন্টাদুয়েক আগে খেয়ে নেওয়া ভাল। খেয়ে যদি সাথে সাথে ঘুমাতে যান তাহলে খাবারটা বার্ণ হলোনা বরং চর্বি হিসেবে তা লিভারে জমা হবে। লিভারে চর্বি না জমার জন্য বিকালে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। আমাদের কার্ডিওলজিস্ট বন্ধুরা বলেন, সকালে বা রাতে হাঁটলে হার্ট এ্যাটাকের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই বিকালে হাঁটাহাঁটি করা ভাল। পাশাপাশি এ্যালকোহলের অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করতে হবে। এ্যালকোহল লিভারে চর্বি জমার একটা বড় কারণ।   

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিছু রোগ আছে যেগুলো লিভারে চর্বি জমার জন্য দায়ী? রোগগুলো কী?      

ডা. মামুন আল মাহতাব: হ্যাঁ, ডায়াবেটিসের কারণে লিভারে চর্বি জমতে পারে। যাদের রক্তে চর্বি বেশি তাদেরও লিভারে চর্বি জমে। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে লিভারে চর্বি জমে। `সি` ভাইরাস ইনফেকশন ও মহিলাদের ক্ষেত্রে পলিসিস্টিক ওভারি হলে লিভারে চর্বি জমে। যাদের ওজন অতিরিক্ত তাদের লিভারেও চর্বি জমে। সেক্ষেত্রে ওজন কমানোর চেষ্টা করতে হবে।   

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: লিভার সুস্থ নেই, মানুষ কিভাবে বুঝবে?   

ডা. মামুন আল মাহতাব: এটা বলা খুব মুশকিল। লিভার খুব মারাত্মকভাবে আক্রান্ত না হলে মানুষ টের পায় না যে তার লিভার অসুস্থ হয়েছে। লিভারের রোগীরা কখনো লিভারের জন্য ডাক্তারের কাছে যায় না। বরং অন্য রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যে তার লিভার আক্রান্ত হয়েছে। যখন বুঝতে পারে তখন বেশি কিছু করার থাকে না। যেমন লিভার সিরোসিস হলে লিভার ফেইলিউর হয়ে পেটে পানি চলে আসে, জন্ডিস হচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে তখনই তারা ডাক্তারের কাছে যায়। তবে লিভারের রোগ হলে পেটের ডান পাশে হালকা ব্যাথা হয়, গ্যাসের সমস্যা হয়, খাওয়া দাওয়ায় রুচি থাকে না ইত্যাদি সমস্যা হয়। না বললেই নয়, যেসব লিভার রোগী আমাদের কাছে আসেন তারা ঘটনাচক্রে আসেন। জ্বর হলে জ্বরের ডাক্তারের কাছে দৌড়ে মানুষ যায় কিন্তু লিভারের অসুখ নিয়ে দৌড়ে লিভারের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরিমাণ কম।  

`বি` ভাইরাস বা `সি` ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেটা হয়, টিকা দিতে গেলে বা আর্মির মিশনে যাওয়ার সময়, বিদেশ যাওয়ার সময় চেকআপ করতে গেলে তখন তারা ডাক্তারের কাছে আসে। ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে যা হয়, আলট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে যখন দেখে লিভারে ফ্যাট, তখন তারা আমাদের কাছে আসে।  

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: লিভারের রোগগুলোতে আক্রান্ত হলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
 
ডা. মামুন আল মাহতাব: যেকোন রোগ চিকিৎসা করার চেয়ে প্রতিরোধ করা ভাল। লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে যদি লিভার ফেইলিউর হয়ে যায় তখন কিন্তু চিকিৎসার আর কোন সুযোগ থাকে না। তখন আমরা সাপোর্টেড ট্রিটমেন্ট করে লিভার রোগীকে ভাল রাখি। হেপাটাইটিস বি, বি ভাইরাস, সি ভাইরাস, ফ্যাটি লিভার- এসব রোগীকে যদি আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে পাই তাহলেও চিকিৎসা করে ভাল করা সম্ভব। কিন্তু যদি শেষ পর্যায়ে চলে যায় তাহলে চিকিৎসার সুযোগ এই মুহুর্তে আমাদের দেশে নেই। লিভার সিরোসিস বা অন্য কারণে লিভার ফেইলিউর হলে চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন করা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সম্পর্কে জানতে চাই।       

ডা. মামুন আল মাহতাব: লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন সাধারণত লিভার সিরোসিস রোগীদের করা হয়, যাদের লিভার ফেইলিউর হয়ে যায়। যখন কোন লিভার সিরোসিস রোগীর পেটে পানি আসে, জন্ডিস দেখা দেয়, রক্ত বমি হয়, অসংলগ্ন কথা বলে- এই চারটির কোন একটি হলে আমরা বুঝি তার লিভার ফেইলিউর হয়েছে। তখন তার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন পড়ে। আবার ভাইরাস হেপাটাইটিস - `এ` বা `ই` ভাইরাস থেকে বা গাছ গাছড়ার ওষুধ খেয়ে লিভার ফেইল করলেও আমরা লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য বলি।

একটি প্রশ্ন সবাই করে যে, লিভার যেহেতু একটি তাই কীভাবে ডোনেট করবে? লিভার বৃদ্ধি পায়। সাধারণত একজন ডোনারের একটি লিভারের তিনভাগের একভাগ কেটে নিয়ে রোগীকে লাগিয়ে দেওয়া হয়। যার শরীরে লিভার প্রতিস্থাপন করা হবে তার আগের লিভারটি কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র রক্তের গ্রুপে মিল থাকলে হয়। যিনি লিভার ডোনেট করে থাকেন তিনি এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারেন। আর যার শরীরে লিভার প্রতিস্থাপন হয় তিনি মাস দুয়েকের মধ্যে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারেন।       

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন কোথায় করা যাবে?     

ডা. মামুন আল মাহতাব: আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত লিভার প্রতিস্থাপনে এগিয়ে আছে। এক্ষেত্রে ওরা বিশ্বের প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে একটি। আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। তবে অতি শীঘ্রই (নতুন বছরের শুরুতে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন শুরু হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে লিভার চিকিৎসায় সফলতা সম্পর্কে কিছু বলুন।    

ডা. মামুন আল মাহতাব: আমরা লিভার মেডিসিন ডাক্তাররা দেশে স্টেম সেল থেরাপী চালু করেছি। এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। স্টেম সেল থেরাপী দিলে লিভার ভাল হয়ে যায়না তবে আমরা যেভাবে স্টেম সেল থেরাপী করি তাতে দেখি লিভার ফাংশান ইমপ্রুভ করে। অর্থাৎ, জন্ডিস কমে আসে, পেটে পানি আসেনা, ফলে রোগীর জীবনটা স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়। অত্যান্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি আমরা ইতোমধ্যে ৯০ জন রোগীর স্টেম সেল থেরাপী করেছি। আমাদের কাজের উপর তিনটা প্রবন্ধ ইতোমধ্যে তিনটা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এটা কেমন ব্যায় সাপেক্ষ তা নির্ভর করে আমরা কীভাবে এটা করছি তার উপর। তবে সাধারণত লাখ খানেকের আশপাশে থাকে।      

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমরা কী আশা করতে পারি যে, সামনে লিভার রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত বা অন্য দেশে যেতে হবে না?    

ডা. মামুন আল মাহতাব: একথা বলার এখনো সময় আসেনি। আগে আমরা লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করি। তাহলে বাকিটা সময় বলে দেবে। ভারতে ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর জন্য প্রতি বছর চাহিদা হচ্ছে ২৫ হাজার লোকের। সেখানে তারা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছে আড়াই হাজার লোকের। অর্থাৎ তারাও সেক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। ফলে আমরা যখন শুরু করব, তাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে। এখনো তো আমরা রক্তেই স্বয়ংসম্পূর্ণ না। অর্থাৎ আমাদের এমন একটা জায়গায় যেতে হবে যেখানে আমাদের আর ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞান যেভাবে উন্নত হচ্ছে তাতে আশা করা যাচ্ছে আগামী এক দশকের মধ্যে ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। হয়তো আমরা ট্রান্সপ্ল্যান্টে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে আছি। কিন্তু স্টেম সেল থেরাপীতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছি। সেই দিক থেকে বলতে পারি এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে যাব। অন্য দেশের রোগীরা এদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটে আসবে।            

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।    

ডা. মামুন আল মাহতাব: আপনাকেও ধন্যবাদ। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জন্য শুভ কামনা।

আআ/এসি