স্বনির্মিত মানুষ স্যামসন এইচ. চৌধুরী
প্রকাশিত : ০১:২০ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০১৯ রবিবার
দেশের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা, বেসরকারি খাতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, অধ্যবসায়ী, স্বচ্ছতার সঙ্গে ন্যায়নীতিনির্ভর ব্যবসায়ী, স্বনির্মিত মানুষ স্যামসন এইচ. চৌধুরী ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে বয়োবৃদ্ধজনিত কারণে পরলোকগমন করেন। ৮৬ বছর বয়সকালের মধ্যে ১৯৫২-২০১২ অর্থাৎ ৬০ বছরই হলো তার সফল ও কর্মচঞ্চল শিল্পজীবন। ১৯২৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে একটি খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণকারী স্যামসন এইচ. চৌধুরী ভারতে পড়াশোনা করে, ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাবনায় ফেরেন ১৯৫২ সালে। মেডিকেল অফিসার পিতা ইয়াকুব এইচ. চৌধুরী এবং মাতা লতিকা চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন স্যামসন এইচ. চৌধুরী। পিতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই দেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে পাবনার আতাইকুলা গ্রামে ১৯৫২ সালে ছোট্ট একটি ওষুধের দোকান চালুর মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। পিতার মৃত্যুর পর স্যামসন চার ভাই ও এক বোনের সংসারের হাল ধরেন। স্যামসন চৌধুরী তার মৃত্যুকালে রেখে যান স্ত্রী আনিতা চৌধুরী, তিন ছেলে স্যামুয়েল এইচ. চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্প-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব অঞ্জন চৌধুরী এবং কন্যা তলা পাত্রকে।
১৯৫৮ সালে তিনি ও তার তিন বন্ধু মিলে স্কয়ার (Square) নামে পাবনার শালগারিয়ায় একটি ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১২ জন শ্রমিক, কাঁচা-পাকা ভবনে ফ্যাক্টরি, কয়েকটি মেশিন ও স্বল্প পুঁজি অথচ আকাশসমান স্বপ্ন ও উদ্যম নিয়ে স্কয়ারের যাত্রা শুরু। স্যামসন দেখেন ম্যালেরিয়া রোগীদের ভারতে উৎপাদিত কুইনাইন চড়া দামে কিনতে হয় অথচ এ কুইনাইন তৈরির কাঁচামাল বা উপাদান তত্কালীন ঈশ্বরদীর দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনিকলে পাওয়া যায়। দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে এবং নিজস্ব লাগসই প্রযুক্তি দিয়ে সেরা গুণগত মান বজায় রেখে সুলভ মূল্যের ওষুধ উৎপাদনে স্কয়ারের যে স্বপ্নযাত্রা, সেই স্কয়ার গ্রুপ এখন বাংলাদেশের সেরা শিল্প পরিবার; যাদের টার্নওভার বর্তমানে ৯০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এ গ্রুপ এখন ফার্মাসিউটিক্যাল, টেক্সটাইল, রেডিমেড গার্মেন্ট, টয়লেট্রিজ, ইলেকট্রনিক, খাদ্য শিল্প প্রভৃতিতে সক্রিয় ও সাফল্যজনকভাবে বিদ্যমান। তিনি স্কয়ারে একটি দক্ষ চৌকস কর্মীবাহিনী এবং বিশ্বমানের পেশাদার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন। সব সহকর্মীর সঙ্গে ছিল তার পিতৃসুলভ আচরণ, প্রগাঢ় প্রশাসনিক ঔদার্য এবং রসাত্মক ও অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার রসে টইটম্বুর ছিল সে সম্পর্ক। তার প্রতিষ্ঠিত শিল্প পরিবারে প্রতিযোগীদের সঙ্গেও তার প্রগাঢ় সুসম্পর্ক। ব্যাংকাররা তাকে সবচেয়ে নিয়মিত ও বিশ্বস্ত গ্রাহক, সঞ্চয়কারী ও ঋণগ্রহীতা হিসেবে পেয়েছিলেন। সরকারি পোষক ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররাও বেসরকারি খাতের এ মহীরুহ ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে সবসময় সম্মান, সমীহ ও সহযোগিতা লাভ করেছেন।
তার মূলমন্ত্র ছিল ‘Quality, Quality, Quality everywhere’ স্কয়ার সামগ্রী, তা সে ওষুধ হোক আর ব্যসন হোক, হাসপাতালের সেবা হোক— সর্বক্ষেত্রে তিনি গুণগত মান বজায় রাখতে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। স্কয়ার গ্রুপ যখন দেশের ইনসুলিন তৈরির উদ্যোগ নেয় তখন দেখা গেছে কত সচেতনতা কত সতর্কতা অবলম্বনের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। নৈতিকতা, ব্যবসায়িক সততা দেশের সেরা শিল্প পরিবার গড়ে তোলায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ২০০৭-০৮ সালে যখন তার স্বনামধন্য ছেলে তপন চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সে সময় স্কয়ার গ্রুপ সরকারের একটি বড় ধরনের নির্মাণ ও সরবরাহের কাজ পায় সব নিয়মকানুন, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই। তিনি নিজে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়ে দেন যেহেতু তার ছেলে সরকারে আছে, তাই নীতিগতভাবে তার কোম্পানি এ সরবরাহের কাজটি নিতে চায় না।
দেশের নবীন শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য তিনি ছিলেন রোল মডেল। অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং সততা ও দক্ষতার সঙ্গে তিলে তিলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য। জীবনে শত বাধা-বিপত্তি ও পরিপার্শ্বের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করেও লক্ষ্য অর্জনে তার অধ্যবসায় ও প্রয়াস-প্রচেষ্টার সাফল্য অন্যের জন্য প্রেরণাদায়ক। তিনি তার পিতৃসুলভ আচরণে বহুজনের হূদয় জয় করেছেন, সান্নিধ্য লাভ করেছেন। মনে আছে আমার বিনিয়োগ বোর্ডের দিনগুলোয় তার সাহচর্য লাভের কথা। বিনিয়োগ বোর্ডে পরিচালক, অর্থ বিভাগে ব্যাংকিং অনুবিভাগে অতিরিক্ত সচিব, প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য এবং সর্বশেষ রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার রেগুলেটরের ভূমিকা পালনকালে তার সঙ্গে নানা কারণে ও উপায়ে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে। এনবিআরের চেয়ারম্যান থাকার সময় আমি সবসময় তার কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ পেয়ে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হয়েছি। তিনি পিতার মতো মুরুব্বিতুল্য, সহপাঠী বন্ধুর মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আমার অফিসে এসে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক ক্ষেত্র সম্পর্কে গভীর তত্ত্ব ও তথ্য বিনিময় করতেন। কেন জানি আশি-ঊর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তি কী স্নেহের টানে সে সময় প্রায়ই আসতেন এনবিআরে এবং আমার খাসকামরায় বসে বসে দেশের শিল্পজগতের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করতেন, পরামর্শ দিতেন। শুল্কায়নের ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম বিষয়াদি কীভাবে দেখা দরকার, তা আমাকে তালিম দিতেন। ভারত থেকে আমার জন্য সে দেশের বিশাল শুল্ক অমানিবাস, এইচ এস কোড কোষগ্রন্থ এনে উপহার দিয়েছিলেন। তার প্রস্তাব ও প্রার্থনা গভীর অভিনিবেশসহকারে স্টাডি করেছি এবং তার কাজ করতে গিয়ে নিজেরা অনেক কিছু শিখেছি। স্বীকার করতে কার্পণ্য নেই যে তার কাছ থেকে আমি করদাতাবান্ধব, শিল্পোদ্যোক্তাবান্ধব, রাজস্ব নীতি নির্ধারণে মনোভঙ্গি অবলম্বনের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বিশেষ করে ইতিবাচক মনোভঙ্গি অর্জনের ক্ষেত্রে অনুশীলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরও তার স্কয়ার ভবনের অফিসে আমাকে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিষয়ভিত্তিক আলাপ-আলোচনার জন্য। মেট্রোপলিটন চেম্বারের অনেক কমিটি সভায়ও তিনি আমাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
জনাব চৌধুরী ছিলেন সৃজনশীল এবং সারল্যের প্রতীক, সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও সেরা গুণগত মান বজায় রাখার পক্ষপাতী। কর্মক্ষেত্রে একটা অনুপ্রেরণা ও অনুসরণযোগ্য পরিবেশ সৃজনে সবার সঙ্গে প্রশাসক নয়, বন্ধুর মতো আচরণে নিষ্ঠ, সহানুভূতিপ্রবণ নিয়োগদাতা, দক্ষ ব্যবস্থাপকের মতো কর্মে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী নিয়োগকর্তা ছিলেন তিনি। তিনি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতেন চাকরিতে নিয়োজিত না হয়ে নিয়োগকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে। ২০১০ সালের এপ্রিলে তাকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নৈতিকতা ও সেবা পদ্ধতি প্রক্রিয়া অবলম্বনের ওপর স্মারক বক্তৃতা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। সেখানে তিনি উদ্যোক্তাদের নৈতিক বল অর্জনের উপায় ও প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন। তার ব্যাংকাররা বলতেন, জনাব চৌধুরীর মতো এমন নিয়মনিষ্ঠ, নিয়মিত, সচেতন ও সজাগ কাস্টমার আর কোনোদিন পাননি বা পাবেন না।
স্যামসন এইচ. চৌধুরী ২০০৪-০৭ সাল পর্যন্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রের মানুষদের নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে স্পর্শকাতরতা থাকলেও তিনি টিআইবির প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালনে আলোক উজ্জ্বল এক আভা ছড়ান চারদিকে। তিনি সত্য কথা ও রূঢ় বাস্তবতার কথা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সামনেও বলতে দ্বিধা করতেন না। তার প্রতিষ্ঠানে সব সহকর্মী সময়মতো বেতন, বোনাস ও প্রণোদনা পেয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানে কোনোদিন ধর্মঘট বা কর্মবিরতির মতো ঘটনা ঘটেনি। তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে আহার করতেন অফিস এমনকি উৎপাদন ফ্যাক্টরিতেও।
স্যামসন এইচ. চৌধুরীর শিল্প সাফল্য এবং তার সততা, দক্ষতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতার অন্তর্লীন ভাবনা ও ভাবদর্শনের বৈশিষ্ট্য তার জীবনী বিশ্লেষকরা তুলে ধরেছেন এভাবে:
Creativity (সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনমূলক নতুন নতুন শিল্প উদ্যোগ গ্রহণ); Good Practices of Ethics (নৈতিকতা, সেরা পদ্ধতি প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান ও প্রয়োগ, ব্যাংকাররা তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে স্বাছন্দ্যবোধ করতেন তার এ ব্যবসায়িক সততা ও নিয়মনিষ্ঠার জন্য); Vertical Integration (নতুন নতুন খাত ও ক্ষেত্রে শিল্পোদ্যোগ গ্রহণে পরস্পর প্রযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ঊর্ধ্বমুখিনতার দর্শন অবলম্বন); Keen to Learn (শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সবসময় জানা-বোঝার ও বিশ্লেষণের আগ্রহ ও গুরুত্বারোপ); Simplicity (অনাড়ম্বরতা, সাদাসিধা সহজ-সরল জীবনযাপন, সবার সঙ্গে মেলামেশা, সবার মতামতকে সম্মান প্রদর্শন); Good employer (একজন ভালো নিয়োগকর্তা হিসেবে, শিল্প মালিক বা কর্তৃপক্ষ হিসেবে, ব্যবসায়িক নেতা হিসেবে জনাব চৌধুরীর সুনাম ও সুকৃতি ছিল ঈর্ষণীয়); Maintaining Best Quality (পণ্য উৎপাদন কিংবা সেবা খাতে সর্বত্র সেরা গুণগত মান বজায় রাখাকে তিনি পরম ধর্ম মনে করতেন); Straight Forward (অকপট, যা বলতেন সরাসরি বলতেন, কোনো প্রকার হেঁয়ালি, দ্ব্যর্থবোধক বা ধোঁয়াশা পরিবেশ তিনি পছন্দ করতেন না); Friendly (সবার সঙ্গে সব পর্যায়ের সঙ্গে অনুপম ও আশুতোষ বন্ধুত্বভাবাপন্ন ছিলেন তিনি); Honestু (সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা, নৈতিকতার মূল্যবোধ পোষণ করতেন, তার সব কাজে এর প্রতিফলন ছিল); Philanthropist (শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সমাজকল্যাণমূলক বহু প্রতিষ্ঠান উদ্যোগে তার ছিল অংশগ্রহণ); Worker for the country (মানবসম্পদ, দক্ষ জনবল, কারখানা কর্মী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ছিল আজীবন অবদান); Corporate social Responsibility (বাংলাদেশে সামাজিক দায়বদ্ধতার দর্শনটি জনাব চৌধুরী দৃশ্যমান করে তোলেন); Good employer (ভালো বেতন, ভালো ব্যবহার এমনকি সাধারণ কর্মীদের একসঙ্গে আহার ছিল নিয়োগকর্তা হিসেবে জনাব চৌধুরীর অনন্য বৈশিষ্ট্য; Developer (আঞ্চলিক ও জাতীয় উন্নয়ন অভিযাত্রায় তিনি ছিলেন একজন গঠনমূলক সহযোগী)।
২০০৬ সালে স্কয়ার গ্রুপ আইসিএবির ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে সেরা হিসাব প্রতিবেদনের জন্য পুরস্কৃত হন। তার গ্রুপ ২০০৭ সালে লাভ করে ‘বেস্ট বিজনেস অ্যাওয়ার্ড’। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন দেশের সেরা ও সুদীর্ঘতম সময়ের করদাতা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০০৮ সালে তাকে এ সম্মাননা দিয়ে নিজেরাই বরং সম্মানিত বোধ করেছে।
লেখক : সাবেক সচিব
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান