রাজনীতির রাজপুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
প্রকাশিত : ১২:১২ পিএম, ৮ জানুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার
রাজনীতির রাজপুত্রের মহাপ্রস্থান। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বাংলাদেশের রাজনীতির রাজপুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। গণকর্মচারী হিসেবে অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি; কিন্তু সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। ভদ্র, সজ্জন, বিনয়ী, মৃদুভাষী, নির্লোভ এবং নিবেদিত মানুষ হিসেবে তিনি সর্বস্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, অসরকারি সংস্থা এবং সর্বোপরি গণমানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। আমার সহকর্মীদের নানা অভিজ্ঞতার কথ শুনেছি অনেকের সম্পর্কে। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ কাউকে কখনও কোনো অন্যায় কিংবা অনিয়ম করার জন্য অনুরোধ করেননি, চাপ প্রয়োগ তো দূরের কথা। আইনে সুযোগ না থাকায় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ময়মনসিংহ শহরে তিনি তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজকে জেলা পরিষদের মালিকানাধীন এক শতক জমিও দিতে অনুরোধ করেননি। অফিসে খুব কম এলেও জরুরি নথিপত্র নিষ্পত্তিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। তার নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রতি বছর গড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করে, যখন জাতীয় গড় ছিল ৮০ শতাংশ। তিনি বলতেন- `সচিব সাহেব, আমি নিয়মিত অফিসে গেলে আপনারা কাজ করতে পারবেন না। সারাদিন লোকজন ভিড় জমাবে মন্ত্রণালয়ে। লোকজনের চাপ সামলাতেই আপনারা গলদঘর্ম হয়ে যাবেন। দিন কেটে যাবে কিন্তু কোনো কাজ হবে না। তার চেয়ে আপনারা নীরবে শান্তিতে আপনাদের কাজ চালিয়ে যান। দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করুন।
১৯৭১ সালে টগবগে যুবক সৈয়দ আশরাফ যোগ দেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। তার পিতা তখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন সম্মুখ সমরে। তাকে কাছ থেকে দেখে বিশ্বাস হতো না, অসীম সাহসের অধিকারী মানুষটি যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য। বরং তাকে মনে হতো একজন দার্শনিক শিক্ষক। বোধ হয় রাজনীতিবিদ না হয়ে শিক্ষক হলে তাকে ভালো লাগত। জ্ঞানপিপাসু মানুষটি আরও জ্ঞান আহরণের জন্য নিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পড়াশোনায় তার কোনো ক্লান্তি ছিল না। খোঁজখবর রাখতেন সারাবিশ্বের রাজনীতি, বিজ্ঞানের এগিয়ে চলা আর উন্নয়নের। মন্ত্রিসভার বৈঠক, একনেক সভা, মন্ত্রিসভা কমিটিতে মাঝেমধ্যে এমনভাবে আলোচনা শুরু করতেন যে, প্রথম দু-তিন মিনিট কেটে যেত তার মূল সুরটা ধরতেই। তার পর বোঝা যেত তিনি বলছেন আগামীর কথা, কয়েক যুগ পরের কথা। সবাই তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা উপভোগ করতেন। ২০০৬-০৮ সালে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনগুলোতে আমরা তাকে দেখেছি ধীর-স্থির-শান্ত কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। লন্ডনের নির্বাসন আর প্রবাস জীবন কাটিয়ে তিনি এসেছিলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যোগ দিতে। সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের স্বপ্নে বিভোর, তখন তিনি দলকে সংগঠিত করেছেন। সাহস জুগিয়েছেন তৃণমূলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে। স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুঃস্বপ্ন কেটে যাওয়ার। মৃদুভাষী মানুষটিকে আমরা মাঝেমধ্যে গর্জে উঠতেও দেখেছি, যখনই প্রয়োজন পড়েছে। ২০১৩-এর ৫ মে যখন হেফাজতিরা রাজধানী দখল করতে এসেছিল, তাণ্ডব চালিয়েছিল সারাদিন, সেই সন্ধ্যায় তিনি স্বভাবসিদ্ধ ভদ্রতা না দেখিয়ে তাদের চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছিলেন সরকারের পক্ষ থেকে।
সৈয়দ আশরাফ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাকে সবসময় দেখেছি উদার গণতন্ত্রের চর্চা করতে। বিচ্যুত হননি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথ থেকে। নিজের দল এবং বিরোধী দল সবাইকেই দেখতেন প্রায় সমান চোখে। প্রকল্প গ্রহণের সময় কখনও বলেননি- ওই এলাকায় বিরোধী দল জিতেছে, ওখানে কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না। কখনও কখনও এমনও হয়েছে, বিরোধীপক্ষের সংসদ সদস্য, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান বরাদ্দের চেয়ে বেশিই পেয়েছেন। ২০১৩ সালে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয় হয়। তখন অনেকেই অভিযোগের তীর ছুড়েছিলেন তার দিকে। আমিও বাদ ছিলাম না। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে অনেক ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। খুব ঠাণ্ডা মাথায় তাকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে দেখেছি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী পরাজয় বরণ করেন। এ নিয়ে আমার ওপর, আমাদের সহকর্মীদের ওপর কোনো চাপ আসতে দেননি তিনি। সব সময় বলেছেন, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করা মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। জনগণ যাকে ভোট দেবে, তিনিই নির্বাচিত হবেন। আমরা তাকেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মেনে নিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাব।
নির্লোভ এই মানুষটির বিরুদ্ধে কেউ কোনো দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। শুদ্ধতার চর্চা করতেন তিনি। খুব সাধারণ পোশাক পরতেন। কখনও ব্র্যান্ডের কাপড়চোপড় পরতে দেখিনি তাকে। এ নিয়ে তার কোনো আগ্রহও ছিল না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যখন অভিযোগ করছিল, সেই সময় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আবাসিক প্রতিনিধি এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে প্রস্তাব দিয়েছিলেন- পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিলে তারা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবে। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে বললাম, স্যার, অ্যালোকেশন অব বিজনেস আমাদের এত বড় সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাদের জানিয়ে দিলেন অ্যালোকেশন অব বিজনেসের কথা। একবার চীন সফরে ভাবি তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তার কাছে টাকা না থাকায় তাকে একজন দলীয় সহকর্মী ৫০০ ডলার ধার দিয়েছিলেন। তিনি তার স্ত্রীকে টাকাটা দেন। পরদিন সেই টাকা ফিরিয়ে দিয়ে জানান, ভাবি তেমন কিছু কেনেননি। একই রকম ঘটনা শুনেছি দিল্লিতে কর্মরত আমার এক সহকর্মীর সহধর্মিণীর কাছ থেকে। ভাবিকে নিয়ে তারা গিয়েছিলেন বাজারে। ভালো কিছু দোকানে নিয়ে যাওয়ার পর ভাবি তাদের বললেন, দামি জিনিস কেনার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। তাই তিনি আমার সহকর্মীর সহধর্মিণীকে চুপি চুপি বললেন সস্তা পণ্যের বাজারে নিয়ে যেতে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল কর্মকর্তাকে বিদায় জানাতে। শেষে সস্তা বাজারের সস্তা দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করেন তিনি।
আমি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি থাকার সময় ক্লাবের আনন্দ মেলায় ভাবিকে আমন্ত্রণ করেছিলাম। তিনি এসেছিলেন। আমার স্ত্রী তাকে একটা ছোট্ট গিফ্ট দিয়েছিলেন। পরদিন তিনি আবার আসেন। মেলায়। খুঁজে বের করেন আমার স্ত্রীকে। তাকে একটা গিফট গছিয়ে দেন। সচিব হওয়ার সুবাদে আমি সৈয়দ আশরাফের সরকারি বাসভবনে গিয়েছি। বাসভবনে খুব সাধারণ মানের আসবাবপত্র। সবই পিডব্লিউডি থেকে দেওয়া, কোনোটি পুরনো, জীর্ণ। কিন্তু তার কোনো চাহিদা ছিল না সেগুলো বদলে দেওয়ার। অনেক মন্ত্রণালয়-বিভাগ তাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বাসায় আসবাবপত্রসহ অনেক কিছুই সরবরাহ করে। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ কখনোই তেমন কিছুর জন্য বলেননি। একবার শুধু দেখতে বলেছেন, তার পুরনো গাড়িটা বদলে দেওয়া যায় কি-না।
সৈয়দ আশরাফ সবসময় আড়ালে থাকতে চাইতেন। নিভৃতচারী স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটির টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর আগ্রহ ছিল না। মিডিয়া থেকে দূরে থাকতেন। তবে সংকটময় সময়ে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তার বক্তব্য হতো কয়েক লাইনের। কোনো চর্বিত-চর্বণ না করে একেবারে সুস্পষ্ট কথা তিনি বলতেন। তার কথায় তিনি কাউকে হেয় করার চেষ্টা করতেন না। কটূক্তি করতেন না কাউকে নিয়ে। করতেন না হাসি-তামাশা। আমাদের নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতিতে তার মতো নির্লোভ, নিরহঙ্কার, স্পষ্টভাষী, পরমতসহিষুষ্ণ মানুষের বড় প্রয়োজন ছিল। একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও হেভিওয়েট মন্ত্রী হয়েও নিজ গুণে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। দলমত নির্বিশেষে মানুষ যে তাকে পছন্দ করত- তা প্রমাণিত হয়েছে শেষ বিদায় জানানোর সময়ে মানুষের ঢল থেকে। বড় অসময়ে তার এই বিদায় আমাদের দেশ ও রাজনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। পরপারে ভালো থাকুন আপনি। গণমানুষের হৃদয়ে এমন স্থান খুব কম রাজনীতিকই পেয়েছেন।
লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব
এসএ/