ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এমন উত্তরাধিকারই তো কাম্য

প্রকাশিত : ০২:৩২ পিএম, ৯ জানুয়ারি ২০১৯ বুধবার

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত রোববার বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত তার জানাজায় লাখ লাখ লোকের শোকমিশ্রিত শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে। দুঃখ-ভারাক্রান্ত কোটি হৃদয়। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকসহ সব মিডিয়ায় তার সরব উপস্থিতি, আলোচনা-সমালোচনা তার গুণাবলির ভাণ্ডার নিয়ে। তার যে গুণাবলির কথা উচ্চারিত হচ্ছে, মোটাদাগে তা হলো :তিনি ছিলেন মনমানসিকতায় আপাদমস্তক একজন পরিশীলিত, আধুনিক ও প্রাগ্রসর চিন্তার মানুষ। ছিলেন সজ্জন, সদালাপী, সৎ, নির্লোভ, নির্মোহ, প্রচারবিমুখ একজন দূরদর্শী পরিপকস্ফ রাজনীতিবিদ। অর্থ-সম্পদের প্রতি তার যেমন লোভ ছিল না; তেমনি তিনি ছিলেন স্বল্পাহারী। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের তিনি নিয়মিত পাঠকও ছিলেন। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতিকে আধুনিক ও প্রাগ্রসর করে গড়ে তোলার জন্য যে রাজনীতি বা ইস্যু সবার সামনে আনাদরকার, তা নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সহমতে পৌঁছে তাকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা কৌশল তিনি সবসময় গ্রহণ করতেন। সবার কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন তার নির্লোভ ও নির্মোহ ব্যক্তিত্বের কারণে। বাংলাদেশে যাতে একটি মৌলবাদী সমাজ গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য এবং সত্যিকার গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য তিনি সবসময় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশ যাতে আরেকটি পাকিস্তানে পরিণত না হতে পারে, সে ব্যাপারে তার কোনো আপস ছিল না, হেলদোল ছিল না। তার ক্ষেত্রে দুটি অ্যাসিড টেস্ট, যা সবারই জানা :১/১১-এর পর তার ভূমিকা এবং গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্য ভূমিকা ও হেফাজতি তাণ্ডব প্রতিহতকরণ।
ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে এক বৈঠকে তিনি আমাদের বলেছিলেন, মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজ চালানোর জন্য প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আছেন। তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নিয়মিত বেতন-ভাতা, পেনশনসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা পান। মন্ত্রীর দায়িত্ব তো রুটিন ওয়ার্ক করা না। যারা সকাল থেকে মন্ত্রণালয়ে থাকেন, তারা কতটুকু মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন অথবা বিভিন্ন তদবিরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তার একটা বিশ্নেষণ দরকার। তা ছাড়া, জনপ্রতিনিধি ও প্রজাতন্ত্রের নিয়মিত বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বের পার্থক্য সম্পর্কে জনগণ, মিডিয়া বা নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের ধারণা রয়েছে, যা সঠিক বা বাস্তবসম্মত নয়। নির্বাচিত মেয়র, সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের দায়িত্ব মশা মারা, ড্রেন ও রাস্তা পরিস্কার করা, রাস্তা নিয়মিত মেরামত বা নির্মাণকাজ তদারকি কিংবা এ ধরনের কাজে সরাসরি যুক্ত থাকা নয়।
আমাদের বোধ হয় সময় এসেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের রুটিন ওয়ার্ক এবং জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্টতা আনা। আমাদের জানা দরকার যে, নির্বাচনের সময় যেসব প্রতিশ্রুতি প্রার্থীরা দেন এবং জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের কাছে প্রত্যাশা করেন, তার সিংহভাগই সম্পন্ন করার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে।
সবশেষে সৈয়দ আশরাফের একমাত্র কন্যা রীমার উদ্দেশে খোলা চিঠির মতো করে আমার কয়েকটি কথা :আমাদের সন্তানরা যারা পিতৃমাতৃহারা হয়, সেই সন্তানদের দুঃখ আমরা যারা বাবা-মা হয়েছি, তারা নিজেদের বুকে অনুভব করি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মা ও বাবাহারা হয়ে রীমা তার ছোট্ট বুকে এই বয়সে যে অপার দুঃখ বহন করছে, তা প্রকাশযোগ্য নয়। আমরা জানি, ১৯৯১ সালের পর থেকে বেশিরভাগ সময় বাবার সান্নিধ্য না পেয়েই তাকে এতটুকু বড় হতে হয়েছে। এ বয়সেই তার এত বড় ধাক্কা সইতে হলো। আমরা আশা করি, এই শোক সে কাটিয়ে উঠতে পারবে। রীমা উত্তরাধিকার হিসেবে আর্থিক সম্পদ হয়তো তেমন কিছু পায়নি; কিন্তু অগ্নিপুরুষ সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাতনি ও সৈয়দ আশরাফের কন্যা হিসেবে সে যে বিরল সম্মানজনক উত্তরাধিকার লাভ করেছে, সে সৌভাগ্য খুব কম সন্তানেরই হয়। তার বাবা ইহলোক ছেড়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের কোটি মানুষের যে বিপুল শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন, সেটা ওর জন্য এমনই এক উত্তরাধিকার, যা থেকে তাকে বঞ্চিত করার শক্তি কারও নেই। আমি শুধু কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা করি- বাংলাদেশের বেশি বেশি সন্তান যেন এ ধরনের উত্তরাধিকার অর্জন করে।
যারা এবার মহান জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন, তাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলব, আপনাদের সন্তানরাও যেন সৈয়দ আশরাফের কন্যার মতো উত্তরাধিকারের ভাগী হতে পারে। আশা করি, সেই চেষ্টা আপনারা করবেন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ
লেখা : সংগ্রহ (সংবাদ পত্রের পাতা থেকে)
এসএ/