ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

অবশেষে ডাকসু নির্বাচন

প্রকাশিত : ০৪:৩০ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৪:৪৬ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০১৯ শনিবার

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হচ্ছে যাচ্ছে। আগামী ৩১ মার্চ এই নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাবির প্রশাসন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে মেধাবী নেতৃত্বের সমারোহ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে তারা।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন,‘রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃত্ব তৈরির কারখানা হলো ছাত্র সংসদ। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। আমরা মার্চের মধ্যেই ডাকসু এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার প্রস্ততি নিচ্ছি।’তিনি বলেন,‘আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিম লে মেধাবী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে চাই।’

ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ডাকসুর ২১ বছরের পুরনো গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি করে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ডাকসুর গঠনতন্ত্রে যুগোপযোগী সংশোধন আনতে ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ১৩টি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি। বৈঠক শেষে ছাত্র সংগঠনগুলোর লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য আগামী সোমবার পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।

ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধিত হয়েছিল। এরপর নির্বাচন না হওয়ায় এটিকে আর পরিমার্জন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতিশিগগির একটি সুন্দর ডাকসু নির্বাচন উপহার দিতে বদ্ধপরিকর, তাই আমরা ছাত্র নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। এখানে প্রায় সব ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন অংশগ্রহণ করে গঠনতন্ত্রের কোথায় কোথায় সংযোজন-বিয়োজন দরকার সে বিষয়ে তাদের বক্তব্য দিয়েছে। যেহেতু অনেকে দাবি করছে তারা পর্যাপ্ত সময় পায়নি সেজন্য আগামী সোমবার পর্যন্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করতে সময় বাড়ানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এরপর ’৯১, ’৯৪, ’৯৫ ও ২০০৫ সালে তফসিল, এমনকি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও কিছু সহিংস ঘটনা, সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা ও ছাত্র সংগঠনের বিরোধিতা ইত্যাদি কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। ২০১২ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’থেকে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিলের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে এ দাবি আবার সামনে আসে। ওই বছরের ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

এদিকে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশনা চেয়ে গত পাঁচ বছরে উচ্চ আদালতে পৃথক দুটি রিট আবেদন করা হয়। কিন্তু জবাব দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছয় বছর আগের একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে গত বছর ১৭ জানুয়ারি এক রায়ে হাই কোর্ট ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সাত মাসেও নির্বাচনের কোনো আয়োজন দৃশ্যমান না হওয়ায় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিস পাঠান রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ অক্টোবর চেম্বার বিচারপতি হাই কোর্টের রায় স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। সেই শুনানি শেষে গত রবিবার হাই কোর্ট জানায়, মার্চে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। এর পরই নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন।

৪৭ বছরে সাতবার ডাকসু নির্বাচন : স্বাধীনতার পর গত ৪৭ বছরে মাত্র সাতবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন যথাক্রমে আমান উল্লাহ আমান এবং খায়রুল কবির খোকন। এরপর ২৮টি বছর পার হয়ে গেলেও ডাকসু নির্বাচন আর হয়নি। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়।

মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। এরপর বিভিন্ন সময় ডাকসুর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসংখ্য প্রতিভাবান নেতা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে আছেন রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, শফি আহমেদ, নাজিম কামরান চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব, প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস মাখন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারউজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, মুশতাক হোসেন, সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সালে আমান উল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।

নেতৃত্ব সৃষ্টির আঁতুড়ঘর : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ হচ্ছে নেতৃত্ব সৃষ্টির আঁতুড়ঘর। কিন্তু দীর্ঘদিন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচিত ছাত্র সংসদ না থাকায় রাজনীতিতে মেধাবী নেতৃত্ব আসছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২৮ বছরে যদি ২৮টি ডাকসু নির্বাচন হতো তাহলে অন্তত শুধু ডাকসুর মাধ্যমেই ৫৬ জন নেতা পাওয়া যেত। এ ছাড়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের দুজন করে সভাপতি ও সম্পাদক পাওয়া যেত। এসব ছাড়াও রয়েছে হল সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে এখন দেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্ধশতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য নেতা বেরিয়ে আসতেন। কয়েক হাজার কলেজে যদি নিয়মিত নির্বাচন হতো তাহলে কয়েক হাজার নেতা বেরিয়ে আসতেন।

যদি দেশে অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক, নিয়মিত ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতো তাহলে আজ বাংলাদেশ এই সহিংস, চাঁদাবাজি ও গু ামির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসত এবং আইনের প্রতি নিষ্ঠাবান শত শত রাজনৈতিক নেতা উপহার দিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুধু ডাকসুই নয়, গত ২৮ বছরে রাকসু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), চাকসু (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), ইউকসুসহ (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। ফলে ছাত্ররাজনীতিতে আজ গতি নেই, আদর্শ ও মূল্যবোধ নেই। ছাত্ররাজনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি।


টিআর/