বিবিসির প্রতিবেদন
কোন বিষয়গুলো সহিংস জিহাদের প্রতি আকৃষ্ট করে?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:২৮ এএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১০:২৯ এএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার
১৫ই জানুয়ারি নাইরোবিতে হোটেলে জঙ্গি হামলায় ২০ জন মারা যায়
মধ্যপ্রাচ্যে খিলাফত বা আদর্শ একটি ইসলামী রাষ্ট্র তৈরির যে স্বপ্ন ইসলামিক স্টেট দেখেছিল তা বলতে গেলে ধূলিসাৎ হয়েছে। সেই জিহাদে যোগ দিতে যাওয়া হাজার হাজার মুসলিম যুবক এখন চরম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। তারা দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করছে, যদিও ফিরলে হয়তো গ্রেপ্তার এবং বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
তবে তথাকথিত ‘ইসলামের শত্রুদের’ নিশ্চিহ্ন করার বাসনা এখনো পুরোপুরি চলে যায়নি। দু’সপ্তাহ আগে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির একটি হোটেলে আল-শাবাব গোষ্ঠীর হামলা তার একটি উদাহরণ। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার বিরাট একটি অঞ্চলে এখনো বিপজ্জনক মাত্রায় জিহাদি হামলার হুমকি বিদ্যমান ।
সোমালিয়া, আফগানিস্তান বা ইয়েমেন এখনও জিহাদিদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু পৃথিবীজুড়ে এখনও কিছু মানুষ কেন সহিংস জিহাদের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে? এর পেছনে নিম্নের কারণগুলো কাজ করতে পারে।
সঙ্গদোষ, বন্ধুদের চাপ
সুস্থ একটি স্বাভাবিক জীবন, পরিবার, সমাজ ছেড়ে বিপজ্জনক একটি পথে পা বাড়ানো একেবারেই ব্যক্তিগত একটি সিদ্ধান্ত। যারা এই জিহাদি তৈরির জন্য কাজ করে, দলে লোক ভেড়ানোর কাজ করে, তারা মূলত বলে যে মুসলমানদের ওপর অবিচার হচ্ছে এবং সেই অবিচার দূর করা একজন মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্ব।
গত ২০ বছর ধরে ইন্টারনেটে এ ধরণের প্রোপাগান্ডা ভিডিওর ছড়াছড়ি। সে সসব ভিডিওতে দেখানো হয়, কীভাবে বিশ্বের নানা জায়গায় মুসলমানরা অবিচার নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিছু ভিডিওতে কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার উদাহরণ দেখানো হয়।
এগুলোর লক্ষ্য দুটো - এক, সহমর্মিতা এবং একইসাথে এক ধরণের লজ্জা এবং অপরাধবোধ তৈরি করা। এমন কথা বলা যে তোমরা ঘরে বসে রয়েছ আর ফিলিস্তিনে, সিরিয়ায়, চেচনিয়ায় তোমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা নির্যাতিত হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে।
দুই, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার দৃশ্য-সম্বলিত ভিডিওগুলো এমন সব তরুণ যুবকদের আকর্ষণ করে - যাদের সহিংস অপরাধের ইতিহাস রয়েছে।
অনেক সময় শুধু বন্ধুদের উস্কানিতে একজন মানুষ সহিংস কাজে উৎসাহিত হতে পারে। উস্কানি না থাকলে তার আচরণ হয়তো স্বাভাবিক ক্রোধের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকতো।
পরিবার এবং সমাজের সাথে যে সব তরুণ-তরুণীর সম্পর্ক আলগা, তাদেরকে দলে ভেড়ানো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। এসব তরুণ-তরুণী দেখে যে গোপন এসব সংগঠন তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে তারা বিকল্প একটি জীবনের প্রতি আকর্ষিত হয়। সেই জীবনটা যদি সুইসাইড বেল্টের ভেতর দিয়েও শেষ হয়, তাতেও তারা পিছপা হয়না।
সুশাসনের অভাব
মধ্যপ্রাচ্য কেন আন্তর্জাতিক জিহাদি-বাদের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো, তার কারণ রয়েছে। এ অঞ্চলের বহু দেশে দুর্নীতিবাজ, অগণতান্ত্রিক এবং নির্যাতনকারী সরকার রয়েছে, যারা যে কোনো বিরুদ্ধ-মতবাদকে শক্ত হাতে দমন করে। সিরিয়া তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ।
আট বছরের গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জয়লাভের পথে। কিন্তু যে হাজার হাজার মানুষকে তিনি জেলে পুরেছিলেন, জিহাদি গোষ্ঠীগুলো তাদের অনেককেই দলে টানতে পেরেছে।
সাদ্দাম হোসেন পরবর্তী ইরাকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা যেভাবে সুন্নিদের অধিকার খর্ব করেছে, তাতে করে ইসলামিক স্টেট নিজেদেরকে সুন্নিদের রক্ষাকারী হিসাবে জাহির করতে সমর্থ হয়েছিল।
আফগানিস্তানে শত শত কোটি ডলারের পশ্চিমা সাহায্য এলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় সে দেশের একের পর এক সরকার। ফলে, তালেবানকে কখনই মোকাবেলা করা যায়নি।
সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন সাহেল অঞ্চলে দারিদ্র এবং বেকারত্ব এতটাই প্রকট যে সেখান থেকে সহিংস জিহাদে লোক সংগ্রহ সহজ।
ধর্মীয় দায়িত্ব
আল কায়েদা, আই এস বা তালেবান সবসময়ই তরুণ তরুণীদের দলে ভেড়াতে ধর্মীয় আনুগত্যের কথা বলে। ধর্মীয় কট্টরবাদ বিশেষজ্ঞ ড. এরিন সল্টম্যান বলেন, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তাদের আদর্শ এবং কর্মকাণ্ডের যুক্তি দিতে গিয়ে সবসময় ধর্মীয় দায়িত্বের যুক্তি দেয়। তারা বলে - সংগ্রাম, আত্মদান এই দায়িত্বেরই অংশ।
যেমন নাইরোবিতে হোটেলে হামলার যুক্তি হিসাবে আল-শাবাব বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে তাদের দুতাবাস তেল আবিব থেকে থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার প্রতিবাদেই এই হামলা।
জেরুজালেমের সাথে সারা পৃথিবীর মুসলিমদের একটি আবেগের সম্পর্ক। সে কারণেই হয়তো আল-শাবাব এখন জেরুজালেমের কথা বলে তাদের আবেদনের ক্ষেত্র সোমালিয়ার বাইরে প্রসারিত করতে চাইছে।
সহিংস জিহাদের যে আদর্শ - তা হয়তো আরো কিছুকাল রয়ে যাবে, কিন্তু বিশ্বের সিংহভাগ মুসলিমই এটাকে সমর্থন করে না। শুধু গোয়েন্দা তৎপরতা বা পুলিশ দিয়ে সহিংস জিহাদ পুরোপুরি মোকাবেলা সম্ভব নয়। সাথে প্রয়োজন সুশাসন ও ন্যায় বিচার - যেগুলোর অভাব মানুষকে ক্ষুব্ধ করে এবং সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
এমএইচ/