দোসা বিক্রি করে মেয়েকে বিবিএ পড়াচ্ছেন জাহাঙ্গীর আলম
আলী আদনান
প্রকাশিত : ১০:১০ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
রাজধানী মোহাম্মদপুরের রিং রোডের টোকিও স্কয়ার একটি ব্যস্ততম এলাকা। সবসময় সেখানে জটলা লেগেই থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে এখানে তরুণ তরুনীদের ভীড় বেড়ে যায়। এই জটলার কারণ অনুসন্ধানে উঁকি মারলেই চোখে পরবে পরপর কয়েকটি দোসা`র দোকান। দোকানগুলো ঘিরে রাখা বেঞ্চগুলোতে ক্রেতারা খাচ্ছে। কেউ কেউ খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে।
মাঝখানের দোকানটিতে একটু বেশী ভিড়। বিক্রেতার মাথায় টুপি। হাত দুটি গরম কড়াইয়ের উপর অনবরত কাজ করছে। নন-স্টিক পাত্রে তেল ব্রাশ করে হাল্কা আঁচে গরম করা হচ্ছে। তেল গরম হয়ে গেলে পাত্রে এক টেবিল চামচ দোসা তৈরির মিশ্রণ ঢালছেন জাহাঙ্গীর আলম। পাত্রের চারদিকে চামচ দিয়ে পাতলা ও গোল করে ছড়িয়ে দিচ্ছে। দোসার নিচের অংশ হালকা বাদামী হয়ে ধারগুলো উঠলে খুব সাবধানে তুলে নিচ্ছে দোসা। দোসা তোলার সময় গোল করে মুড়িয়ে নিচ্ছে। প্রতিবার পাত্রে দোসার মিশ্রণ দেয়ার আগে পাত্রটি কাপড় দিয়ে মুছে তেল ব্রাশ করে নিচ্ছে। প্রস্তুত হওয়া দোসা প্লেটে করে ডাল ভুনা, সবজি, তেতুল বা জলপাইয়ের চাটনি, নারকেল মিষ্টি চাটনি, আমের আচার বা দই দিয়ে পরিবেশন করছেন জাহাঙ্গীর আলম ও তার ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছেলে।
রাজধানী ঢাকার ফুটপাতের খাবারের দোকানে নিয়মিত ক্রেতা পাওয়া কঠিন। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমের দোকানে সন্ধ্যায় এমন কিছু ক্রেতা আছেন যারা প্রায়ই আসেন।
এই দোসা বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের বাড়ী চাঁদপুর। অভাবের সংসারে বাবার লড়াই দেখতে দেখতে এক সময় চলে আসেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য ছিল বাবা মাকে সাহায্য করা। এই ঢাকায় প্রথম জীবনে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়েছে তাকে। কখনো হোটেলের কর্মচারী, কখনো অফিসের পিয়ন, কখনো ফুটপাতে তরকারি বিক্রি এবং ফুটপাতে চা বিক্রিও করেছেন তিনি। হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় জহিরুল হক নামে এক বাবুর্চির সঙ্গে। জাহাঙ্গীর আলমের ভাষায় কারীগর। এই কারীগরের কাছে থেকে পান তিনি দোসা তৈরীর বিদ্যা।
দোসা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দোসা দক্ষিন ভারতের খাবার। এদেশে বড় বড় শপিংমলে পাওয়া যায়। বড় লোকেরা অনেক টাকা খরচ করে খায়। আমি গরীবের দোকানদার। আমার এখানে কম দামে দোসা পাওয়া যায়।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি তিন ধরনের দোসা বিক্রি করি। মাসালা দোসা, এগ দোসা ও চিকেন দোসা। মাসালা দোসা পঞ্চাশ টাকা, এগ দোসা সত্তর টাকা, চিকেন দোসা নব্বই টাকা। তবে মাসালা দোসা বেশি বিক্রী হয়।
দোসা কীভাবে তৈরী করেন জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি আর কী বানাই! আসল দোসা বানাতো আমার গুরু জহিরুল হক। তার হাতের দোসা যে একবার খেয়েছে তার মুখে লেগে আছে সারাজীবন। সেদ্ধ করা পোলাওয়ের চাল, কলাইয়ের ডাল, খাবার সোডা, লবণ, চিনি ইত্যাদি কোনটা কী পরিমাণে দিতে হবে তা বুঝতে হবে। জাহাঙ্গীর আলম মুচকী হেসে বলেন, খাবারের স্বাদ নির্ভর করে উপাদানের অনুপাতের উপর। অনুপাত কম বেশি হলে শেষ!
জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর আদাবরে তিন সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন তিনি। বড় মেয়ে লালমাটিয়া কলেজে বিবিএ পড়ছে। ছেলে রিফাত ক্লাস সেভেনের ছাত্র। সবচেয়ে ছোট ছেলেটি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাসা ভাড়া দেন নয় হাজার টাকা। বাড়ীতে নিয়মিত বাবা মাকে টাকা পাঠাতে হয় তাকে। ছোট দুই ভাইকে দোসা বিক্রির টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। দুটি বোন বিয়ে দিয়েছেন তাও দোসা বিক্রির টাকায়।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার বাবা গরীব ছিলেন। তাই আমরা পড়াশুনা করতে পারিনি। আমি চাই আমার সন্তানেরা পড়াশুনা শিখে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। তিনি আরও বলেন, মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায় মানুষের অবমূল্যায়ন দেখে। কেউ কেউ খুব তাচ্ছিল্য করে কারণ আমার পড়াশুনা নাই। কোন কোন ক্রেতাও মাঝে মাঝে অপমান করে কথা বলে। মন খারাপ হলেও হজম করে যাই। আমার সন্তানেরা মানুষ হলে আমিও বুক ফুলিয়ে চলতে পারবো।
এসি