ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

বই উৎসব হোক দক্ষতার মাদকতা

ড. শরীফ এনামুল কবির

প্রকাশিত : ০৯:৫৭ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার

ড. শরীফ এনামুল কবির

ড. শরীফ এনামুল কবির

গত কয়েক বছর ধরে বছরের প্রথম দিন একটি দৃশ্য মন কাড়ে। শহরাঞ্চলে এমন দৃশ্য দেখা না গেলেও এমন দৃশ্যের দেখা মেলে সারাদেশ জুড়েই, প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রামগুলোতেও। হলুদাভ শর্ষে ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে যাচ্ছে একদল কিশোর-কিশোরী। সবার হাতে নতুন বই। এই তো কিছুক্ষণ আগেই স্কুল থেকে পাওয়া। সবার চোখে মুখে হাসির আলোকছটা। শিশুরা বারবার বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরা বইয়ে বারবার মুখ গুঁজে ঘ্রাণ নিচ্ছে। শর্ষে ফুলের মৌ মৌ গন্ধের মাঝে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ যেন আরেক মাদকতা তৈরি করে। এ মাদকতা সৃষ্টির, নিজেকে ছাড়িয়ে জ্ঞানের অসীমে মেলে ধরার। এ মাদকতা আধুনিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রমাণের, বিশ্বজনীন প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে লালসবুজের পতাকাটাকে পতপত করে আরও উঁচুতে তুলে ধরার।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উৎসবের খাতায় যোগ হয়েছে বই উৎসব। বর্ষবরণ, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ধারাক্রমের বাইরে বাংলাদেশের বই উৎসব এক নতুন সংযোজন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মনোযোগী হন শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নে। এ লক্ষ্যে নেওয়া হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। এরই অংশ হিসেবে নতুন বছরের শুরুতে বই বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে, এক্কেবারে তৃণমূল পর্যায়েও আনন্দের বার্তা বয়ে যাওয়ার একটা রীতি তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। আর অভিভাবকদের মাঝে বাড়ে সচেতনতা। আগে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে বিনামূল্যে বই পেলেও মাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রীদের কিনে নিতে হতো লাইব্রেরি থেকে। বই কিনতে অপেক্ষা করতে হতো মাসের পর মাস। অনেক সময় প্রয়োজনীয় বই না পেয়েই ত্রৈমাসিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো শিক্ষার্থীদের। ২০১০ শিক্ষাবর্ষে বর্তমান সরকার প্রথমবার বিনামূল্যে বই বিতরণের উদ্যোগ নেয়। সে বছরই ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে সরকার। এর পর থেকে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে বিতরণ করা বইয়ের সংখ্যাও। এর পর থেকে প্রতি বছর প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিতরণ করা হয়েছে নতুন বই।

চলতি ইংরেজি বছরের প্রথমদিন দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের চার কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন পাঠ্যবই। এ বছর মোট ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ খানা বই বিতরণ করা হয়েছে এসব শিক্ষার্থীদের মাঝে। নতুন বছরের আনন্দে নতুন ক্লাসে ওঠা শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর হাতে সদ্য ছাপানো ঝকঝকে পাঠ্যবই। মজার ব্যাপার হলো, সারাদেশে এক যোগে বই বিতরণ করা হয়। শীতের সকালে গরম রোদে নতুনত্বের উঞ্চতায় এসব শিক্ষার্থীরা প্রবল আগ্রহে বই গ্রহণ করে। সঙ্গে উপস্থিত অভিভাবকদের মাঝেও দেখা যায় আনন্দের ঝিলিক। গত কয়েকবছরের মধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। এই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কচি শিক্ষার্থীদের মাঝে যখন বই বিতরণ করা হয়, তখন আনন্দ ও খুশিতে তারা বইয়ের উল্টাতে শুরু করে পাতা। প্রাণখোলা হাসিতে বই নিয়ে খুনসুটিতে মেতে উঠে সহপাঠীদের সঙ্গে। এ দৃশ্যের উৎসব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের সবক`টি বিদ্যালয়ে। `নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটব, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশজুড়ে উড়ব’ প্রতিপাদ্যের মতোই শিশু কিশোর শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দের ঢেউয়ে ভাসতে থাকে। বই হাতে পেয়ে এর গন্ধ শুঁকে হাতে নতুন বই উঁচিয়ে ঢাক- ঢোলের তালে মাঠ জুড়ে ছোটাছুটি করে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে বছরের প্রথম দিনেই শুরু হয় আনন্দের যাত্রা, জ্ঞানার্জনের স্পৃহা। আগ্রহ তৈরি হয় শ্রেণির সবগুলো বই আত্মস্থ করার। এটা যে একধরণের আগ্রহ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মাঝে, তা অন্য কোনো উদ্দীপনার বক্তব্য থেকে তৈরি করা সম্ভব নয়। আবার, শিক্ষকরাও সচেষ্ট হয়ে উঠেন দায়িত্বপালনে। আর অভিভাবকদের মাঝেও জাগে সন্তানের প্রতি নজর দেওয়ার বাসনার।

দেশের অনাগত ভবিষ্যৎকে যেসব শিশু-কিশোর নির্মাণ করবে, তাদের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করতেই সরকারের সৃজনশীল এই পদক্ষেপ। হিমের পরশমাখা শুভ্র সকালে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে সারাদেশের শিশু-কিশোররা আনন্দের আকাশে পাখনা মেলে। তাদের চোখেমুখে বিচ্ছুরিত হতে থাকে অজানাকে জানতে চাওয়ার আনন্দ। শিশু-কিশোরদের উল্লাস দেখে অভিভাবক আর শিক্ষকদের মুখেও ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।

শিক্ষা-পরিবার ও জাতির জন্য এই দিনটি অনন্য গুরুত্ব বহন করে নিঃসন্দেহে। কেননা এক যোগে সারাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের মধ্যেই জ্ঞানপিপাসা মেটানোর উদ্ভাবনী এই উদ্যোগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানার্জনের দারুণ উদ্দীপণা তৈরি করে। দেশের শিক্ষার ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কেননা, শিক্ষা, জ্ঞানার্জন, সভ্যতার দিক দিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশই হয়তো বাংলাদেশকে অতিক্রম করে গেছে। যুগোপযোগী শিক্ষা হতে আমরা হয়তো এখনও খানিকটা পিছিয়ে। তবে, জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ও আধুনিক শিক্ষায় দক্ষ নাগরিক তৈরিতে আমাদের যে উদ্যোগ, তা পৃথিবীর আর কোনো দেশেই নেই। আর কোনো দেশই পারেনি শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে এত বই বিতরণ করতে। কেবল আমরাই পেরেছি দায়িত্ব নিয়ে সরকারি উদ্যোগে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ তৈরির উদ্যোগ নিতে। একসময় হয়তো আমরা গরিব ছিলাম। কিন্তু তা এখন কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি। এখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে বলতে শিখেছি, আমার দেশের ছেলেমেয়েরা মেধায় দরিদ্র্য নয়। তারা মেধায় বিশ্বমানের। তারা এমনভাবে গড়ে উঠছে যে, তারা বিশ্ব জয় করতে সক্ষম।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের প্রথম দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসবের মধ্য দিয়ে চার কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই বিতরণ করা হয়। গত নয় বছর বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ এক হাজার ৯১২টি বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে গত ১০ বছরে ২৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯৪টি বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের নির্দেশনায়। এই পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সফলতার অনন্য রেকর্ড করেছে। এই বিরল কৃতিত্বের অধিকার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। এ কথা বলা যায় নির্ধিদ্বায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জনের কোনো শেষ নেই। তবে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার অর্জন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্জন। শিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে না পারলে জ্ঞানভিত্তিক জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। যেন আমাদের ছেলেমেয়েরা পৃথিবীর উপযোগী মানসম্মত হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে যেন অবদান রাখতে পারে।

যদিও এখন চ্যালেঞ্জের রকমফেরেও পরিবর্তন আসছে। সব জায়গায় ডিজিটাইশেসনের প্রভাব। এখন নতুন বইয়ের প্রভাবে ডিজিটাইজেশনের নেতিবাচক দিককে প্রতিহত করা এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ করাটাও আমাদের দায়িত্বের বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশি সংস্কৃতির আধিপত্যে আমাদের শিশুরা যেন হারিয়ে না যায়, তাদের জ্ঞানার্জনের পথে যেন সামান্য বাধাও তৈরি করতে না পারে, তার বড় সিদ্ধান্তটা কিন্তু জানান দেয় এই বিপুল সমারোহের বই উৎসবই। ডোরিমন আর পাতলা মোটুর পৃথিবী যেন বিস্তৃত না হয় আমাদের কচিমনের শিশুদের পড়ার টেবিলে। শোলকবলা কাজলা দিদির গল্পের কথা হয়তো আগের মতো করে নতুন প্রজন্ম জানার সুযোগ পাবে না, তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, আমাদের জাতীয় বীর শ্রেষ্ঠ, একুশের অহংকার, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব নানা স্মারক যেন আমাদের শিশু কিশোরদের মনে গ্রথিত হয়, তার চেষ্টাও কিন্তু আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে থাকতে হবে।
শিক্ষার গুণগত মান রক্ষার বিষয়টি সবসময়ই চ্যালেঞ্জের। তবে এসব চ্যালেঞ্জের উত্তোরণে স্বক্রিয় সরকার। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মান উন্নয়নের জন্য সরকার অনেকগুলো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কলেজ শিক্ষার মান, শিখন ও শিক্ষণব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পরিচালনা মান উন্নয়নের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে সৃজনশীল কর্মসূচি। শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই উন্নত মানসম্পন্ন শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে সেদিকেও নজর রয়েছে সরকারের। কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজের সার্বিক পরিবর্তন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, সে লক্ষ্যে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি ও পদক্ষেপ। আর দক্ষতা অর্জন করে বাস্তব জীবনে তা কাজে লাগাতে পারে, এ লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামও চালু রয়েছে।

তবে, একটি কথা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার উন্নয়নে বরাবরই উদার। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে আগের চেয়ে তিনি বহুগুণ বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এসব প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে মাঠ পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তাদের দায়িত্বপালনে মনোযোগী হতে হবে। সবপর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিতের তৎপরতা বাড়াতে হবে। কেন্দ্র থেকে গৃহীত পদক্ষেপ যদি তৃণমূল পর্যায়ে ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হয়, তবেই বই উৎসবের মতো জ্ঞানী ও দক্ষ প্রজন্ম গড়ে উঠবে। তখন দক্ষতা উৎসব করে আনন্দের পূর্ণতা উপভোগ করার জন্য আয়োজন করা যাবে আরেকটি সার্বজনীন উৎসবের। সে পথেই হাঁটুক আগামীর বাংলাদেশ, বই উৎসব হোক আমাদের প্রেরণার।

লেখক: সাবেক সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন,
সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এসএইচ/