ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

দুর্নীতি দমনই হতে পারে সোনার বাংলা গড়ার প্রধান অনুঘটক

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) :

প্রকাশিত : ০১:০৯ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার

দুর্নীতি একটা রাষ্ট্রের জন্য রাসায়নিক অস্ত্র ও আণবিক বোমার চাইতেও বেশি ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র। দুর্নীতি শুধু উন্নয়নকে ব্যাহত করে তাই নয়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। যক্ষ্মার মতো সমগ্র জাতিকে কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ ও নিস্তেজ করে ফেলে। শক্তিহীন মানুষের মতো তখন শক্তিহীন জাতিকে কেউ বাইরে থেকে একটু ধাক্কা দিলেই পড়ে যায়। সুতরাং, দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে রাষ্ট্রের কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হবে না এবং অর্জিত সাফল্যও টেকসই হবে না। একটা দুর্নীতিমুক্ত আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে। রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান, সোনার বাংলা গড়তে চান। তিনি আরো বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই। বঙ্গবন্ধু জানতেন— চাইলেই সোনার মানুষ পাওয়া যায় না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সোনার মানুষ তৈরি করতে হয়। দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমই কেবল একজন মানুষকে সোনার মানুষ করতে পারে। পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সেটা ছিল একেবারেই অসম্ভব বিষয়। তাই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, এদেশের মানুষকে সমস্ত অশুভ রাহুর কবল থেকে মুক্ত করতে হলে প্রথমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে এবং তার জন্য সমগ্র জাতির রাজনৈতিক মানসকাঠামোর ঐক্যবদ্ধতা প্রয়োজন। ক্যারিশমেটিক বা সম্মোহনী নেতৃত্বের গুণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সেটা করতে পেরেছিলেন। সমগ্র জাতির মানসকাঠামো যদি এক জায়গায় মিলিত না হতো তাহলে স্বাধীনতা লাভের মতো এতবড় সাফল্য এত অল্প সময়ের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব হতো না।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সমস্ত অশুভ শক্তির কবল থেকে মুক্ত করবেন, এটি তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে ছিল। তাই দুর্নীতিমুক্ত শোষণহীন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় মানসকাঠামো তৈরির জন্য অর্থাত্ তাঁর আকাঙ্ক্ষিত সোনার মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি ঢেলে সাজাতে চাইলেন। কারণ উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। নীতি-নৈতিকতা সংবলিত আদর্শবান মানুষ তৈরি করতে হলে উপযুক্ত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু গঠন করলেন কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে কমিশন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার মানুষ তৈরির উপযোগী একটা অনন্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। একটা জাতির মানসকাঠামো তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লাগে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ পেলেন না। ১৯৭৫ সালের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কুদরত-ই-খুদা কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করে দিলেন। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শগত যে অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন সেটাও জিয়াউর রহমান ভেঙে তছনছ করে দিলেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতির একেবারে মৌলিক আদর্শগত জায়গায় জাতি আবার বিভক্ত হয়ে গেল। এটাই ছিল মহা সর্বনাশের শুরু। তারপর পালাক্রমে দুই সামরিক শাসক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করার নীতি গ্রহণ করলেন। ১৫ বছর চললো এই ধারা। তাতে যা হবার তা-ই হলো।
সামরিক শাসকদ্বয়ের মেহেরবাণীতে অনেক মানুষ লোভনীয় পদ-পদবি, এমপি, মন্ত্রী হয়ে গেলেন বিনাশ্রমে রাতারাতি। এমন হয়েছে, অনেককেই রাতের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলা হয়েছে আপনি মন্ত্রী-এমপি হবেন। আপনার কিছু করতে হবে না, যা কিছু করার আমরা করব। সুতরাং, জনগণের কথা ভেবে যন্ত্রণা পোহাবার পরিবর্তে এসব পদপ্রাপ্তরা হয়ে গেলেন সামরিক শাসকের চাটুকার ও পদলেহী। তাতে প্রাপ্তিও যেমন, তেমনি সাত খুন মাপ। সামরিক শাসকদ্বয়ের হাত ধরে আবির্ভূত হওয়া সুবিধাবাদিদের দৌরাত্ম্যে মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধ সবকিছুই কেবল কেতাবি বস্তু হয়ে গেল, বাস্তবতায় তার কোনো চিহ্ন আর রইল না। সুবচন নির্বাসনে চলে গেল। সামরিক শাসনের বদৌলতে দুর্নীতির যে সিংহ-দুয়ার সেদিন খুলে গেল সেটি পরবর্তীকালে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির মতো প্রবেশ করে আজ মহাপ্লাবনের রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন দুর্নীতি। রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি যদি মতাদর্শগতভাবে নীতি-নৈতিকতা এবং শুভচিন্তার পক্ষে না থাকে তাহলে সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যায়। বিগত সময়ে বাংলাদেশে সেটাই ঘটেছে। তাই এই বাস্তবতায় ১৬ কোটি মানুষের এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শুভচিন্তার পক্ষে ফিরিয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ দরকার। সর্বপ্রথম কাজ রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনা। এই কঠিন কাজটিই গত ৩৮ বছর ধরে করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও আদর্শের একান্ত অনুসারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মহাগ্রাসী দুর্নীতির মতো সুবিশাল জাতীয় ইস্যুকে বিচ্ছিন্ন ও এককভাবে বিবেচনা করলে হবে না, বিগতদিনের সমস্ত ঘটনাবলি এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতির সামগ্রিক ইস্যুর সঙ্গে মিলিয়ে এক সঙ্গে দেখতে হবে। গত দশ বছর এক নাগাড়ে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি বিশ্বের নজর কেড়েছেন। রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জায়গায় ফিরিয়ে আনার পথেও অগ্রগতি অনেক। বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতের রাজনীতি প্রায় নিঃশেষিত। তারপর বাংলাদেশে জামায়াতের পুনর্জন্মদাতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতি আজ ভঙ্গুর অবস্থায়। তবে আত্মতুষ্টি ও আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই। রাজনীতিকে শুদ্ধিকরণ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর ফিরিয়ে আনার পথে এখনো বড় বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। তবে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সবচাইতে বড় আশার জায়গা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুড়ি এখন অনেক গভীর ও বিস্তৃত। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের সচেতন মানুষ এবং নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকে একজন পরিপক্ব নেতা হিসেবে চেনেন ও জানেন। বৈশ্বিক সংকট ও ইস্যুতে শেখ হাসিনার অবস্থান এবং কথার মূল্য অনেক বেশি। বৈশ্বিক জলবায়ু ইস্যুতে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাস, জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনার অবস্থান, বক্তব্য ও সাফল্য সর্বত্রই প্রশংসিত। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির চরম জটিল এবং দ্বন্দ্বময় সমীকরণে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় তিনি অসামান্য দূরদৃষ্টি ও পরিপক্বতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং, প্রকৃতই সোনার বাংলা গড়ার কাজে আগামী পাঁচ বছরেও পূর্বের দশ বছরের মতো শেখ হাসিনা আঞ্চলিক সব বড় শক্তিসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাবেন।
তবে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি। প্রথমত, দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণ এবং দ্বিতীয়ত, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র প্রতিহতকরণ। তাই এখন শুরু থেকেই নতুন সরকারকে একই সঙ্গে ও সময়ে সমানতালে তিনটি অ্যাপ্রোচে মার্চ করে সামনে এগোতে হবে। প্রথমত, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের অ্যাপ্রোচে বুলডজিং এবং অনমনীয় কঠিন ও হূদয়হীন অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ও মালয়েশিয়ার মাহাথির যে বিশ্বের রোল মডেল হয়েছেন, তার পিছনে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের আপসহীন অবস্থান। দুইজনের আত্মজীবনীতেই একথার উল্লেখ আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অ্যাপ্রোচের সমান্তরালে দ্বিতীয় কাজটি হবে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার অ্যাপ্রোচ এবং তৃতীয় সমান্তরাল অ্যাপ্রোচ হবে, নির্ঘাত ষড়যন্ত্র হবে ধরে নিয়ে সেটি প্রতিহতকরণের অ্যাপ্রোচ। ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন পূর্বের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সতর্ক। তবে আধুনিক যুগেও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের জাল ভেদ করে ১৯৯৫ সালের ৪ নভেম্বর দিনে দুপুরে ইসরাইলের শান্তিকামী প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনকে হত্যা করতে সক্ষম হয় ইহুদি ধর্মান্ধ এক যুবক আইগাল আমির। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের অভ্যন্তরে নিজের বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন ভারতের অন্যতম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। সুতরাং পথ মসৃণ নয়।
উন্নয়নের কথা বলতে গেলেই এখন বলতে হবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে গেছে। এই চলাকে নির্বিঘ্ন রাখার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। অর্থাত্ দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা গেলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে ব্যাপক হারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য আকাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তখন ষড়যন্ত্রকারীরাও হালে পানি পাবে না। প্রোপাগান্ডা, অপপ্রচার কাজে আসবে না। সুতরাং, রাজনীতি শুদ্ধিকরণসহ সুশাসন, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও ষড়যন্ত্র প্রতিহতকরণের প্রধান অনুঘটক হবে দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণ। সেটা করতে পারলেই আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আর শুধু স্বপ্ন থাকবে না, বাস্তবে রূপ নেবে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
এসএ/