ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার সামাজিক ভূমিকা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

প্রকাশিত : ০৪:৩৩ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৯:১৮ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার

শিক্ষাবিদ, অধ্যাত্মপুরুষ, সমাজসেবক খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার (১৮৭৩-১৯৬৫) মন-প্রাণ জুড়ে ছিল মানুষের সেবা করা, ধর্ম ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষকে প্রদীপ্ত করা। তার প্রধান উপলব্ধি হলো, ‘সৃষ্টিকে ভালো না বাসলে স্রষ্টাকে ভালোবাসা যায় না।’ অবসর জীবনের শুরু থেকে মৃত্যুপূর্ব ৩৪ বছরে যে ৭১টি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন, তার মধ্যেও পাওয়া যায় এ মনমানসিকতার পরিচয়। এই নিবেদিতপ্রাণ ভক্তের অকৃত্রিম ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি, ধর্ম ও কওমের প্রতি, তার পূর্বপুরুষদের প্রতি, পিতামাতার প্রতি, আপন শিক্ষকদের প্রতি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতার প্রতি। এ ভক্তিপূত মনোভাবই তাকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘আহ্ছানিয়া মিশন’-এর ভিত্তিমূল তৈরিতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।

‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’— এ আদর্শে ১৯৩৫ সালে তিনি তার স্বগ্রাম সাতক্ষীরা জেলার নলতায় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সর্বজনীন মানবিক ও অধ্যাত্ম আদর্শে প্রতিষ্ঠিত একটি মানবসেবা ও মানবকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। আহ্ছানউল্লা উদ্যোগী, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও অতুলনীয় মনীষার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন জাগতিক বিধান এবং আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনার সেতুবন্ধ। শরিয়ত ছিল তার দেহ, আর তরিকত ছিল তার প্রাণ। এ দুটি পন্থার সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য সাধনের মহৎ পন্থাবলি বিশ্বকে জানাতে তিনি ছিলেন উদগ্রীব। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার সাজুয্য লাভ এবং মহানবী (দ.)-এর অনুকরণে ইসলাম প্রচারের মহান দায়িত্ব নিয়ে আহ্ছানউল্লা তার জনৈক বন্ধু মৌলভী আব্দুল করিম খানের পরামর্শে একটি মিশন গড়ে তোলেন।

তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে ১০ নভেম্বর ‘নলতা আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাতার গুজারেশ’ বক্তৃতায় অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেন,

‘আপনাদের নিকট আমি সম্মানের প্রার্থী নহি। আমি প্রার্থী আপনাদের মঙ্গলের, আপনাদের শান্তির, আপনাদের আনন্দের। আমি চাই আপনাদের খেদমত করিতে, আমি চাই আপনাদের কল্যাণের জন্য স্বীয় স্বার্থ, স্বীয় সুখ, স্বীয় গৌরব বিলাইয়া দিতে। ...হে মানববৃন্দ। সত্যিকারের এনছানিয়াত (মনুষ্যত্ব) অর্জন করিয়া ধন্য হউন। বাবাসব, ভাইসব, মাসব, বোনসব, আপনারা কর্মী হউন। হিংসা-দ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতাকে বিসর্জন দিয়া প্রেমিকের সাজ লইয়া তরিকতের শৃঙ্খলে সবাইকে প্রীতির রজ্জুতে আবদ্ধ করিয়া সমাজকে গৌরবান্বিত করুন।’

তিনি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করেছিলেন, জনসেবা আল্লাহতা’য়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য একান্ত দরকারি। তাই তার প্রতিষ্ঠিত আহ্ছানিয়া মিশনের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি হলো জনসাধারণের খেদমত, তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াবি শিক্ষাদানের চেষ্টা— কোনো বৃত্তিমূলক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা। অনাথ গরিবদের শিক্ষার জন্য অবৈতনিক স্কুল স্থাপন ও স্ত্রীলোকদের জন্য সূচি শিল্পের ব্যবস্থা তারই ইচ্ছার বাস্তব রূপায়ণ। তার লিখিত প্রায় সব পুস্তকেই জনসেবার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।

‘ঈর্ষা, দ্বেষ, অহংকার, হিংসাবৃত্তিকে দমন করে আত্মার শক্তি বৃদ্ধি করা’-কে মিশনের অন্যতম লক্ষ্য স্থির করেছিলেন তিনি। এ কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, শহর থেকে দূরে এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে এবং সেখানে মিশন স্থাপন করে মানবকল্যাণে কাজ করাকেই তিনি তার জীবনের মূল লক্ষ্য বলে স্থির করেছিলেন। তিনি আজীবন কর্মে নিয়োজিত হয়েছিলেন মানবসেবার মধ্যে যে অপার আনন্দ নিহিত, তা লাভের আকাঙ্ক্ষায়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেন এভাবে—

‘নিজকে মহৎ মনে করিলে জনসাধারণের সহিত গলাগলি মেশামেশি করা যায় না। নিজকে যতক্ষণ ক্ষুদ্র মনে না করা যায়, ততক্ষণ ক্ষুদ্রের সহিত মহব্বত জন্মে না। যিনি আমাদের শিক্ষাগুরু, যিনি খোদার শ্রেষ্ঠ হাবিব, তিনি হাবশী-বালক জায়েদ-পুত্র-ওছমার সহিত একই উটের পিঠে একাসনে বসিয়া মক্কা বিজয় করিয়াছিলেন। তাঁহার উম্মতের দাবি করিতে হইলে তাঁহার পায়রবী করা একান্ত আবশ্যক। আমরা মুখে বলি হজরতের উম্মত, আর ব্যবহার করি ফেরাউনের মত। আমিত্বকে বিনষ্ট করা অতি কঠিন। আর ইহাই তরীকতের প্রথম শিক্ষা। খুদী থাকিলে খোদাকে পাওয়া যায় না, খোদার ভক্ত হইতে হইলে সৃষ্ট জীব মাত্রকেই বুকে লইয়া আলিঙ্গন করিতে হইবে। আমরা বলি খোদাকে ভালোবাসি, কিন্তু তাঁহারই সৃষ্ট নিম্ন শ্রেণীর লোক দেখিলে ঘৃণা বোধ করি; ইছলামে ঘৃণা বা তুচ্ছতা নাই, ইছলামে অস্পৃশ্যতা নাই, ইছলামে সাদা কালো বিচার নাই, সবাই ভাই ভাই, সকলকে ভালবাসো, কিন্তু সব অপেক্ষা খোদাকে ভালবাসো। আমরা দানকে ভালবাসি, কিন্তু দাতাকে ইয়াদ করি না, দানে মুগ্ধ হইয়া তাহাকেই পূজা করি, আর পূজ্যতমকে বিস্মৃত হই। কামিনী-কাঞ্চন খোদার দান- খোদা নহে। দানকে পাইয়া দাতাকে ভালোবাসিতে হইবে, দানে মুগ্ধ হইয়া থাকিলে শেরক করা হয়। খোদাকে সর্বোত্তম স্থান দিয়া তাঁহারই দানকে তাঁহারই নিয়ামত মনে করিয়া যত্ন করিতে হইবে। অনুগ্রাহককে ভুলিয়া অনুগ্রহদানে মুগ্ধ থাকিলে যে অনুগ্রাহক অসন্তুষ্ট হইবেন, তাহা আমরা বুঝি কৈ?’

আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি

(১) ‘সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য’ ৬১১ সালে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) কর্তৃক গঠিত ‘হিলফুল ফজল’ সমিতির ধারণা ও আদর্শ থেকে এবং

(২) শ্রী রামকৃষ্ণের ধর্মীয় চেতনার জীবনদর্শনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) কর্তৃক ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১ মে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের ধারণা ও আদর্শ থেকে।

সমকালের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয় ছাড়াও ধর্ম ও শিক্ষা বিষয়ে মতামত প্রকাশ ও কর্মসূচি গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ সালের ৮ মে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম মুসলিম সংগঠন আঞ্জুমানে ইসলামীর আদলে আহ্ছানিয়া মিশনের নামকরণে না গিয়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের কর্মধারার বিপরীতে এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সর্ববাদী মতবাদের মাধ্যমে মানবসেবার মিশনধর্মী আকাঙ্ক্ষাতেই আঞ্জুমানের পরিবর্তে ‘মিশন’-এর নামকরণ এবং এখানেই আহ্ছানিয়া মিশনের কর্মধারার স্বকীয়তা ও সমধর্মী অন্যান্য সংগঠন থেকে এর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত। বলা বাহুল্য, আঞ্জুমানে ইসলামী (১৮৫৫) ছাড়াও মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি (১৮৬৩), ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৭) এবং ঢাকা মুসলিম সুহূদ সমিতির (১৮৯১) মতো পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের থেকে আহ্ছানিয়া মিশনের কর্মসূচি ও করণীয় ছিল নানা অভিধায় অভিনব। এটা লক্ষণীয়, বিশ শতকের তিরিশের দশকে কোনো মুসলমান মনীষী কর্তৃক ‘মিশন’ শব্দ ব্যবহার করে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ একটি বিরল ঘটনা। সে সময়ে শরিফ মুসলমান রাজনীতিক বা সমাজহিতৈষী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ সংগঠনের নামকরণ আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ছিলেন সর্বাংশে আধুনিক ও প্রগতিশীল। ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো কূপমণ্ডূকতা, সংকীর্ণতা বা সীমাবদ্ধতা তাকে আবদ্ধ করতে পারেনি। ‘মিশন’ কথাটির শাব্দিক অর্থের যে বহুমাত্রিকতা, প্রসারতা ও ব্যাপকতা, তাকে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন নানাভাবে। তার সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন ও সাধনাকে তিনি কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছেন এ মিশন শব্দটির মধ্যে।

১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আহ্ছানিয়া মিশনের উদ্দেশ্য-বিধেয় বিনির্মাণে ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের প্রভাব সম্পর্কে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা নিজেই লিখেছেন:

‘এখানে রামকৃষ্ণ মিশনের কথা উল্লেখযোগ্য। দুঃস্থের সেবা করাই উক্ত মিশনের লক্ষ্য। ইহার দ্বারা কত স্থানে হাসপাতাল, শিক্ষামন্দির, পান্থশালা প্রস্তুত হইতেছে, আর আমরা নিজের সেবায় দিবারাত্র ব্যস্ত। মোছলেম সমাজে এই অভাব দেখিয়া ‘আহছানিয়া মিশন’ নামে একটি সমিতি গঠন করা হইয়াছে। অপরের খেদমত করাই ইহার উদ্দেশ্য, অন্য উদ্দেশ্য হইতেছে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, দুঃখীর অভাব নিবারণ, শিশু ও বয়স্কদিগের দীনিয়াত শিক্ষাদান, পরদা সংরক্ষণ, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি।’

লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান