ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

বাড়ছে ভালোবাসার ফুল বাজার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৫৭ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৬:০১ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রবিবার

সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতার প্রতীক ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। ফুলের চাহিদা তাই ক্রমবর্ধমান। সারা বছরই বিয়ে, জন্মদিন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ নানান অনুষ্ঠানে প্রয়োজন ফুলের। রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি ও ভালোবাসা দিবসের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসবও। এসব উৎসবে ফুল হয়ে উঠেছে অন্যতম উপজীব্য। ফুলের এ চাহিদাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই বাড়ছে ফুলের বাজার।

ফুলের চাহিদা কম-বেশি সারাবছরই থাতে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে এ চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কেননা এ মাসেই রয়েছে পহেলা ফাল্গুন, বিশ্বভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারির মতো দিবস। এসব দিবসে কাউকে সন্তুষ্ট করতে বা মনের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ফুলের জুড়ি মেলা ভার।

প্রতিবারের মতো এবারও তাই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীর ফুল বাজারগুলোতে লেগেছে ব্যস্ততার ছোঁয়া। ক্রেতার হাতে তরতাজা ফুল পৌঁছে দিতে এরইমধ্যে তোড়জোড় শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।

আগারগাঁও পাইকারী ফুল বাজার সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ ফুল সমিতির সহ সভাপতি এ আর বাচ্চু খাঁ বলেন, দেশ ও দেশের বাইরে যে কোন উৎসবে ফুল এখন অন্যতম একটি উপজীব্য। ফুল ছাড়া কোন অনুষ্ঠানই যেন এখন অপূর্ণ থেকে যায়। ফুলের এ চাহিদার কারণে প্রতিবছরই দেশে ফুলের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।

বছরের কয়েকটি দিন আমাদের বেচাকেনার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। এসব দিনগুলোর মধ্যে বিশ্বভালোবাসা দিবসে আমাদের সবচেয়ে বেশি বেঁচাকেনা হয়। দিবসটি ঘিরে যশোরের গদখালী, ঝিনাইদহ, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে ফুল আসবে। দিবসটিতে আমরা ক্রেতার কাছে তরতাজা ফুল পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। প্রতিবছরই ফুলের চাহিদা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়। এবারও ফুল ব্যবসা গত বারের চেয়ে দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছি।

জাতীয় কৃষি বাতায়নের তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ৫০ জাতের ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬০০ হেক্টর। এটা মোট ফুল আবাদি জমির ৭৪ ভাগ। ২য় স্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ ৬৯০ হেক্টর বা মোট আবাদের ২০ ভাগ।

জানা যায়, ১৯৮৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছার পানিসারা গ্রামে কৃষক শের আলীর মাধ্যমে মাত্র শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ জমিতে দেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয়। সেই দৃশ্যপট বদলে এখন সারা দেশে ২৫টি জেলায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুলের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে।

যশোরের গদখালি ফুল চাষী মাসুম রানা বলেন, ফুল চাষ করে এখন গদখালির মানুষ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বি হওয়ার কথা ভাবতে পারে। একটা সময় ছিল মানুষ এ ফুলের কদর বুঝতো না। এখন দেশ ও দেশের বাহিরে ফুলের চাহিদা ব্যাপক। ফলে ফুল চাষ করে সহজেই দেশ ও দেশের বাইরে বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে। চাষী ক্ষেতে বসেই ফুলের দাম পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য চাষাবাদের তুলনায় ফুল চাষটা একটু সখের ও গর্বেরও বিষয়।

এছাড়া ৩য় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ ১২১ হেক্টর বা ৩ দশমিক ৪৪ ভাগ। এছাড়া রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ হয়। যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কৃষক। এদের মধ্যে খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ২৫০ জন (৭৫ শতাংশ), ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার জন (২০ শতাংশ)। বাকি ৫ শতাংশ কৃষক রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে ফুল চাষে নিয়োজিত।

তাছাড়া ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায় প্রায় দুই লাখ মানুষ জড়িত। আর এ খাতের কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন আরও প্রায় ৭ লাখ মানুষ। উৎপাদিত ফুল দেশের চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করছে। কিছু ফুল বিদেশে রফতানিও হচ্ছে। যার মাধ্যমে আসছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এসব বাস্তবতার কারণে ফুল আবাদে আগ্রহী হচ্ছে বড় বড় খামারিরাও।

সম্প্রতি ‘ফুলের চাষাবাদ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্যতম ব্যবসায়িক সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, নব্বইয়ের দশকের আগে দেশে ফুলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হতো।

আর এখন দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই চাহিদার ৯০ শতাংশ মেটানো যাচ্ছে। বর্তমানে সার্বিকভাবে ফুলের বাজার মূল্য প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিছু ফুল আমদানি হলেও এখন দেশ থেকে ফুল রফতানিও হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গোলাপ ও গ্লাডিওলাস মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত, দুবাই, কাতার ও আবুধাবিতে যায়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় হাজারখানেক স্থায়ী ও অস্থায়ী ফুলের দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানে প্রতিদিনের গড় বিক্রি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। যা উৎসবকেন্দ্রিক কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

তথ্যমতে, দেশে ২০০৮ সালে ফুল রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩৭৬ কোটি টাকা। বর্তমানে বছরে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার ফুল রফতানি হয়। এর মধ্যে তাজা, শুকনো ও কৃত্রিম ফুল রয়েছে। দেশের বাজার ও রফতানির বাজার ধরে এ খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। একে কেন্দ্র করে গ্রামে বাড়ছে টাকার প্রবাহ। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্যমতে, ফুল উৎপাদন ও বাণিজ্যিক চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত ১৪৫টি দেশ। বর্তমানে বিশ্বে বার্ষিক ফুলের চাহিদার পারিমাণ প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে ফুলের বাজার প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে সারা দেশে ফুলের চাহিদা থাকলেও তার বেশিরভাগই রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে রাজধানী এখন এই ফুলের প্রধান বাজারে পরিণত হয়েছে। এক সময় রাজধানীর হাইকোর্ট মাজারের সামনে ফুলের বিপণিবিতানগুলো ছিল। আর এখন তা শাহবাগ, কাঁটাবন, খামারবাড়ী, ধানমণ্ডি, বনানী, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীবাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। শাহবাগে শিশুপার্কসংলগ্ন এলাকায় বসে অন্যতম পাইকারি বাজার।

ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির তথ্যানুযায়ী, সারা ঢাকায় ফুটপাতসহ অভিজাত ফুল বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা এখন প্রায় এক হাজার। আর সারা দেশে এই সংখ্যা চার হাজারের ওপরে।

স্বাভাবিক সময়ে যে কেনাবেচা হয়, তাতে কখনও কখনও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত লাভ হয়। তবে বিশেষ দিনে এই হার অনেক ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশে গিয়ে ঠেকে।

রাজধানী শাহবাগ ফুলবাজারে নীলকণ্ঠ ফুল ঘরের স্বত্ত্বাধিকারী মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, আমাদের রোজ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেচাকেনা হয়। তবে ভালোবাসা দিবসে বিকিকিনি তিনগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। আশা করছি এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।

আগারগাঁও পাইকারী ফুল বাজার সমিতি ও বাংলাদেশ ফুল সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসাইন বলেন, দেশের মানুষের এখন আগের তুলনায় অভাভ নেই। দেশ অনেক উন্নত হয়েছে। তাই মানুষের চাহিদারও পরিবর্তন এসেছে। আগে মানুষ কোন উৎসবে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী ছাড়া ভাবতে পারতো না। এখন সে সব দাওয়াত বা উৎসবে মানুষ খুশি রাখার জন্য অন্যতম উপকরণ হিসেবে ফুল বেঁছে নিয়েছে। ফলে প্রতিবছরই এ ফুলের চাহিদা বাড়ছে।

আরকে//