বাঙালির চেতনায় বসন্ত বরণ
কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক
প্রকাশিত : ১১:৫৪ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০৫:২৬ পিএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
জরাজীর্ণ শীতের পর বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে নতুন রুপে। বাঙালি প্রাণ যখন বসন্ত বরণ করছে ঠিক তখন সম্ভাবনার এক নতুন বাংলাদেশ দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব বাঙালি। এ স্বপ্নকে চেতনায় ধারণ করেই প্রকৃতিতে লেগেছে বসন্তের ছোঁয়া। বসন্ত অনন্ত সম্ভাবনার ঋতু। প্রেম, বিরহ, মিলন, দ্রোহ-সংগ্রাম, বিজয় আর অনিবার্য নিয়তির পথে নতুন স্বপ্নে পাড়ি দেওয়া এক অধ্যায়ের অনন্য নাম।
বসন্ত মানেই চোখ-ধাঁধানো ফুলের সমাহার। ফাল্গুন এলেই কেবলই উঁকি দেয় সে রাঙা সম্ভাবনার সমস্থ দ্বার। এদিনেই সকলকে স্মরণ করে দেয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই ভূবন বিখ্যাত পঙতিদ্বয় ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত।’
বসন্তকে নিয়ে বাঙালির কৌতূহলের শেষ নেই। বসন্তকে নিয়ে আবেগ তাড়িত বাঙালি- কবি- সাহিত্যিকরা লিখেছেন অনন্য অসাধারণ সব গান-কবিতা। বসন্তের গানে মাতোয়ারা বাঙালির কণ্ঠে উঠে বসন্ত বন্দনা-
‘বাতাসে বহিছে প্রেম নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছু বসন্ত এসে গেছে/ মধুর অমৃত গানে জানা গেল সহজে / মরমে এসেছে বাণী বসন্ত এসে গেছে.....!
বসন্ত বন্দনায় মন আনমনে গেয়ে উঠে - ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...আমার আপনহারা প্রাণ/ আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ....../ তোমার অশোকে কিং সুখে, অলক্ষে রঙ লাগলো আমার অকারণের সুখে..../ পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনী গন্ধায়/ রুপ সাগরের পাড়ের পানি উদাসী মন দায়।’
এছাড়া- ‘রঙ লাগালে বনে বনে, ঢেউ জাগালে সমীরণে, আজ ভুবনের দুয়ার খোলা, দোল দিয়েছে বনের দোলা’- প্রকৃতি আজ খুলে দেবে দখিন দুয়ার। বইবে ফাগুনের মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া।’
নতুন করে জেগে উঠা, নতুন আনন্দে-আশায় রঙিন হয়ে ওঠার আবাহনে সে হাওয়া গাইবে- ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল।’
এদিকে বসন্তের উন্মাদনায় বাতাসে কোকিলের কুহুতান। মাতাল হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, উতরোল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠবার আভাসে, আমের মুকুলে, পল্লব মর্মরে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে শীতের রুক্ষ দিনের অবসান: ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে...।
‘বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফাগুনের ছোঁয়া, আগুনরাঙা বসন্তের মোহময় সুর। হিম-কুয়াশায় ঢাকা শীতের পর রুক্ষ মৃতপ্রায় নিসর্গে উষ্ণতার স্পর্শ দিয়ে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে এনেছে বসন্ত।
বসন্তের প্রথম সকালে বাংলার চপলা নারীরা যেদিন বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে, কপালে টিপ, হাতে কাঁচের চুড়ি, পায়ে নূপুর, খোঁপায় ফুল জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়বে সেদিন চির যৌবনা বসন্ত প্রকৃতিতে স্পস্ট হয়ে উঠে। বসন্ত পোশাক পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরা ছেলেরাও সঙ্গী হবে বসন্তবরণের বিভিন্ন আয়োজনে। দখিনা হাওয়া, মৌমাছির গুঞ্জরণ, কচি-কিশলয় আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন আজ।
প্রাকৃতিক রূপ-রসে, কোকিলের কুহুতান, আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। বসন্তের রঙিনদোলা, উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি।
কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে- ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে/ ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে/ আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।’
অবশ্যই পলাশ-শিমুলের অভাব ঘুচিয়ে দেয় হলুদ গাঁদা। বসন্ত মানেই সুন্দরের আহ্বান, জীবনের জয়গান। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। দখিনা হাওয়ার টানে ধূসর প্রকৃতি জাগবে প্রাণের সাড়ায়।
ঝরা পাতার দিন শেষে গাছের শাখায় শাখায় উঁকি দেবে আজ কচি পাতা। প্রকৃতি সাজবে নতুনরূপে। শীতের খোলসে ঢুকে থাকা পলাশ, শিমূল, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া জেগে উঠবে অলৌকিক স্পর্শে।
প্রকৃতিতে নৈসর্গিক প্রাণ ও রূপের আগমনে গুঞ্জন তুলবে ভ্রমর। গাছে-গাছে ছড়িয়ে পড়বে পলাশ আর শিমূলের রূপের আগুন। আজ কেবলই শুরু, পাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে কুহু কুহু ডাকে হৃদয় উচাটন করে তুলবে বসন্তের দূত কোকিল। আকুল ব্যাকুল করে তুলবে বিরহী অন্তর।
নিসর্গের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতি হয়ে উঠবে বাঙ্ঘময়। বসন্ত কেবল একটি ঋতুই নয়। আমাদের নতুন করে জেগে উঠার, বেঁচে থাকার প্রেরণাও বটে।
সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ-ব্যর্থতা ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওবার দুর্নিবার প্রচেষ্টার বার্তা আমরা বসন্তে পেয়ে থাকি। বসন্ত এলেই বনের নিভৃত কোণে, মেঠোপথের ধারে কারও দেখার অপেক্ষা না করেই ফোটে কত নাম না-জানা ফুল।
আমাদের কবিতায় সংগীতে সুর মাধুরীতে বসন্ত ঋতু ভিন্ন ভাবেই ধরা দিয়েছে। ঋতুরাজ বসন্তের রুপ মাধুরী আর মানুষের জীবনে বসন্তের প্রভাব নিয়ে অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। যা অন্য কোন ঋতুর ভাগ্যে এমনটা জোটেনি।
বসন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আন্দোলিত করে গেছে। তিনি বসন্ত নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গান-কবিতা। তার অমর সৃষ্টি-‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়।’
বাউল হৃদয় গেয়ে উঠে-‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ূরের মতো নাচেরে।’
প্রেমের ঋতু বসন্তে প্রেমিক মন আনমনে গেয়ে উঠবে- ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/প্রেম করেছি আমি...।‘
বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়। বিশেষত কবিতা ও গানে ফাল্গুন আর বসন্তের রূপ চিত্রিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুষঙ্গে- অনুপ্রাস, উপমা, উৎপ্রেক্ষায়।
কাজী নজরুল ইসলাম বসন্তের আগমনীতে গেয়েছেন- ‘বসন্ত এলো এলো এলো রে, পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহরে মুহু মুহু কুহু কুহু তানে।’ বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত একটি বাউল গান- ‘নারী হয় লজ্জাতে লাল, ফাল্গুনে লাল শিমূল বন, এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন... মন রে...’।
ভাটিবাংলার গান-‘বসন্ত বাতাসে...সই গো/ বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...।’
উদাসী মনে বসন্ত প্রেমের বার্তা নিয়ে আসে–‘কে তুমি বাঁশরিয়া মধু ভরা বসন্তে... বাঁশির সুরে পাগল করেছো।’
কিশোরী আনমনা প্রেমিকা তাঁর কাঙ্খিত হলুদ গাঁদা ফুলের অপেক্ষায় থেকে প্রেমিকের উদ্দেশ্যে গায়তে থাকে ‘হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা ফুল এনে দে এনে দে নইলে বাঁধবো না, বাঁধবো না চুল।’
আমাদের জীবনে বসন্তের আগমনী বার্তায় দ্রোহ বিপ্লব আর যেকোন অপশক্তির বিরুদ্বে সোচ্ছার হওয়ার বার্তা দেয়। বসন্ত আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তরঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপর রং ছড়ায়।
১৯৫২ সালের ৮ই ফাল্গুন ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা ‘বাংলা’র জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, সফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। সে আত্মত্যাগ আজ বিশ্বস্বীকৃত।
বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত, শোক নয় সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী মোকাবিলায় দুর্বিনীত সাহস আর অপরিমেয় শক্তি নিয়ে।
একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার মিলেমিশে একাকার হয় এদিনে।
প্রতিবছর বসন্তেই আমরা হৃদয়ের শতত আবেগ নিয়ে ভাষা শহীদদের স্মৃতির স্মরণে আমরা গেয়ে উঠি অমর সে গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভূলিতে পারি.....?
সেই সাথে প্রকৃতির অগণিত ফোটা ফুলের পাঁপড়ির মতো শব্দের বাগানে ফুটে অসংখ্য নতুন বই। বাঙালির মননশীলতার কাননে মুক্তচিন্তার ঝংকার যেকোন অশুভ শক্তির বিরুদ্বে উচ্ছারিত হয় বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ থেকে।
ফাগুন তথা বসন্তকাল এলেই গ্রাম থেকে নগর-আবহমান বাংলার সর্বত্রই শুরু হয়ে মেলার মৌসুম। পুরো বসন্তকালে সারা দেশে বসবে লোকজ মেলা। সেই সাথে লোকসংস্কৃতির অনন্য প্রতীক –কারুশিল্প, হস্তশিল্পের পণ্যের মেলায়। বসন্তের রাতগুলোতে প্রত্যন্ত গ্রামে শুনা যেত ঢাক-ঢোলক আর কীর্তনের গান। যা এখন প্রায় বিলুপ্ত।
বসন্তের উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে নাগরিক বাঙালির মন। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ চলবে শহর থেকে গ্রামীণ জীবনেও। বসন্তকে তারা আরও নিবিড়ভাবে বরণ করে। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। সর্বজনীন প্রাণের উৎসবে বাঙালি হৃদয় অনুভব করবে প্রেম-বিরহ আর নতুনের আবাহন।
বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তের উপরও রং ছড়ায়। এই বসন্তে বাঙালির দ্রোহ প্রেম আর দেশপ্রেমের অনন্য নজির রয়েছে। কেননা আমাদের ভাষা- স্বাধীনতা সংগ্রাম এই বসন্তে শুরু হয়েছিল। তাই এই বসন্তে বাঙালি হৃদয় কিছুতেই ঘরে থাকে না। যেমনি থাকেনি- বাহান্ন ও একাত্তরে। যেকোনো সংকটে বাঙালিকে জেগে উঠতে এই বসন্ত সাহস যুগিয়েছে। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্ব দরবারে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে সামনে এগিয়ে যাবে এই মর্মে আমাদের কাজ করতে হবে এ হোক আমাদের শপথ।
লেখক-সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক।