ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়িয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ০৫:৩৫ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মঙ্গলবার

ইতিহাস ও ঐতিহ্য অমূল্য সম্পদ। তবে দীর্ঘ চলার পথে মধুময় স্বপ্নের সঙ্গে দুঃস্বপ্নও ইতিহাসের অংশ। স্বপ্নের মধ্যে দুঃস্বপ্ন থাকবে না—এমন কথা কেউ বলতে পারে না। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি পাঠকের আকর্ষণ বাড়ায়। তবে দুঃস্বপ্ন বা ট্র্যাজেডি কাটিয়ে ওঠার কাহিনি মানুষকে আরো বেশি টানে। কারণ তার ভেতরে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের স্বকীয়তা, সক্ষমতা, শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে মাত্র আট বছরের মাথায় কিভাবে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটাই আজকের লেখার প্রসঙ্গ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে বিজিবি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, যার আগের নাম বিডিআর বা বাংলাদেশ রাইফেলস। সীমান্তের অতন্দ্রপ্রহরীর মন্ত্রে দীক্ষিত এই বাহিনীর সুবিশাল ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে।

১৭৯৫ সালের ২৯ জুন রামগড় স্থানীয় বাহিনী নামে যে ফোর্সটি গঠিত হয়, তা কালের বিবর্তনে ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে বিডিআর বা বাংলাদেশ রাইফেলস নামে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরিণতিতে ২০১০ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে নতুন পোশাক, নতুন পতাকা ও মনোগ্রাম নিয়ে নতুন নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, সংক্ষেপে বিজিবি হিসেবে নব উদ্যমে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির নারকীয় ও বর্বরোচিত ঘটনার সময় বাহিনীর প্রধানসহ ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করা হয়। তবে এত বড় ঘটনার মাত্র আট বছরের মাথায় দীর্ঘ নিয়মতান্ত্রিক আইনিপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রথমে নিম্ন আদালত এবং তারপর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারিক আদালত হাইকোর্ট কর্তৃক গত ২৭ নভেম্বর বিশাল এই মামলার নিষ্পত্তির মাধ্যমে নজিরবিহীন বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে এ রকম নৃশংস অপরাধ করে কেউ আর রেহাই পাবে না। হত্যা মামলায় মোট আসামি ছিল ৮৫০ জন। মামলা চলাকালে আদালতে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ৬৫৪ জনের। একটি মামলায় এতসংখ্যক আসামি ও সাক্ষীর ঘটনাও নজিরবিহীন। রাষ্ট্রপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ১৩৯ জনের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন ও ২২৮ জনকে মেয়াদি শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এত বড় জঘন্য ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে অপরাধীদের জন্য সহানুভূতি ও মার্জনার কোনো সুযোগ নেই। এই কঠিন শাস্তিই তাদের প্রাপ্য ছিল।

স্বজন হারানোর বেদনা কখনো পূরণ হবে না। তবে রাষ্ট্র স্বজনহারাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে, দোষীদের শাস্তি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই বিচার আগামী দিনে বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা সুসংহত রাখতে উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহী প্রথমে বিশ্বাসঘাতক মোশতাক এবং পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতির পিতার স্বঘোষিত খুনিদের বিচারের পথ বন্ধের জন্য আইন করেন এবং সেই আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত করেন। তারপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ওই খুনিদের পুরস্কৃত করেছে, দূতাবাসে মর্যাদাপূর্ণ চাকরি দিয়েছে, পদোন্নতি দিয়েছে। সভ্য দেশের কোনো সরকার এটা করতে পারে, তা ভাবা যায় না! সেই জায়গা থেকে রাষ্ট্র আজ বের হয়ে আসতে পেরেছে, এটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিশাল অর্জন ও অগ্রগতি। তবে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারে হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত কতকগুলো পর্যবেক্ষণের দিকে তাকালে বোঝা যায়, রাষ্ট্র তাই বলে সব দুর্বলতা থেকে বের হতে পেরেছে, তা বলার সময় এখনো আসেনি।

পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, এর মধ্যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে বিপদে ফেলা ও রাজনৈতিক সংকট তৈরির চেষ্টা ছিল। কারা ষড়যন্ত্র করতে পারে সে সম্পর্কে মামলার তদন্তে এবং আদালতের পর্যবেক্ষণে কিছু উল্লেখ নেই। তখন নবগঠিত সরকারের বয়স ছিল মাত্র ৫০ দিন। আট বছর পর আবার ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ওই নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ কতকগুলো অঙ্গীকার করে। যেমন—জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ এবং ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে অস্ত্রপাচার মামলার বিচার হবে। এই অঙ্গীকার নিয়ে যে সরকার গঠিত হলো তার মাত্র ৫০ দিনের মাথায় ঘটল আলোচ্য পিলখানা হত্যাকাণ্ড। সুতরাং আদালত কর্তৃক প্রদত্ত ষড়যন্ত্রের ও সরকারকে বিপদে ফেলার পর্যবেক্ষণের মধ্যে যথেষ্ট মেরিট ও চিন্তার খোরাক রয়েছে।

হাইকোর্টের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচিতে বিডিআরের মতো ফোর্সকে নিয়োজিত করা ঠিক হয়নি এবং ভবিষ্যতে কোনো বাহিনীকে যেন এমন কাজে জড়ানো না হায়। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই পর্যবেক্ষণটির গুরুত্বও অনেক। চলমান কলুষিত রাজনীতিকে ঠিক না করে বরং সেই রাজনীতির পদস্খলনের পরিণতি ঠেকাতে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্বে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করার মতো দায়িত্বহীন কথাবার্তা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নয়। তার পরও কিছু কিছু রাজনৈতিক পক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য দুই পায়ে খাড়া হয়ে থাকে, এটাই তার প্রমাণ। ২০০৮ সালে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতাকে ঢাকা দেওয়ার জন্য বিডিআরকে তাদের পেশাবহির্ভূত ডাল-ভাত কর্মসূচিতে নামিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের কত বড় ক্ষতি করেছে, তা তো এখন সবাই আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গণতান্ত্রিক জবাবদিহির কথা বললে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারাও এই ভয়াবহতার দায় এড়াতে পারেন না।

পেশাবহির্ভূত কাজ বাহিনীর মূলস্তম্ভ শৃঙ্খলা, নীতি ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে ফেলে। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কথা হাইকোর্ট পর্যাবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন। এর সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।

পিলখানার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা পুনর্গঠন ও সংস্কারের কথা তখন প্রবলভাবে অনুভূত হয়। তাদের কাজকর্মের সমন্বয় সাধন ও দেখভাল করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কর্তৃপক্ষ থাকা দরকার বলে তখন অনেকেই মতামত প্রকাশ করেন। প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই এ রকম কর্তৃপক্ষ রয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন নামে ও কাঠামোতে। কোনো কোনো দেশে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল এ কাজটি করে থাকে। ২০০৯ সালে সংঘটিত কলঙ্ক হয়তো ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। তবে গত আট বছরে নবরূপে, নতুন বিন্যাসে যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আইনগত, কাঠামোগত এবং কমান্ড বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিছুদিন আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্মিলিত এক সেমিনারে যোগদান উপলক্ষে আমি প্রায় দুই দিন ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গায় বিজিবির সদস্যদের সঙ্গে ছিলাম। সব পদবির সদস্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করেছি, আচার-আচরণ লক্ষ করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, জাতীয় গৌরবের অধিকারী এই বাহিনী সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে আরো নব উদ্যমে সুসংগঠিত হতে সক্ষম হয়েছে। কারো চোখে-মুখে আমি কালিমার চিহ্ন দেখিনি।

ঘুরে দাঁড়ানোর কয়েকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করার মতো। এক. কমান্ড চ্যানেলকে শক্তিশালীকরণ এবং সার্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গত আট বছরে চারটি আঞ্চলিক সদর দপ্তর, চারটি সেক্টর ও ১২-১৩টি ব্যাটালিয়ন নতুন করে গঠন করা হয়েছে। পিলখানা সদর দপ্তর থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ও সেক্টর সদর দপ্তরের অধীনে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র গোয়েন্দা সংস্থা তৈরি করা হয়েছে। দুই. সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ ও চোরাচালান রোধের ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্রায় ১০০ নতুন বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট) স্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ৪৭৯ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্তে নতুন প্রায় ৪২টি বিওপি স্থাপন করে ২৮৭ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হয়েছে। তবে আরো প্রায় ২০০ কিলোমিটার সীমান্ত অতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিওপি স্থাপন করা জরুরি। সার্বক্ষণিক টহল সুবিধার্থে সীমান্তের কাছাকাছি সমান্তরাল সড়ক নির্মাণ করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। চোরাচালান রোধ করার চেয়েও এখন জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আন্তঃসীমান্ত অবাধ চলাচল বন্ধে বিওপির সংখ্যা বৃদ্ধি ও সীমান্ত সড়কের বিকল্প নেই। তিন. প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। চার. বেতন-ভাতা, ছুটি, রেশন, চিকিৎসা, আবাসনসহ বিজিবি সদস্যদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার্থে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

২২০ বছরেরও অধিক সময়ের ঐতিহ্যবাহী আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ২০১০ সালের নতুন আইনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বিন্যাসে নবযুগের যাত্রা শুরু করেছে। যেতে হবে বহুদূর। আমরা প্রত্যাশা করি, আমাদের সীমান্তের অতন্দ্রপ্রহরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সদা সচেষ্ট থাকবে। বিজিবি দিবস-২০১৭ উপলক্ষে বাহিনীর সব সদস্যকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com