কাজী মেহেদী হাসান’র বয়ানে ফারদুন সিরিজ-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৪৭ পিএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ১০:৪৭ পিএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার
“আমিই সেই বদ্ধমূল সাজা
কারারুদ্ধ করেছি কবিজীবন”
ফারদুন সিরিজ। সুবর্ণ আদিত্য। দুটো নাম আলাদা করে লেখা যায়? লাগছে আলাদা? তা লাগুক। উপরের দুটো লাইন যদি তিনি আত্মস্থ করে থাকেন তবে কী যায় আসে আর!
সিরিজ কবিতাকে আমি দুঃসাহস বলি, মানে কঠিন ব্যাপার। কবিরাই সেই কাজগুলো করবেন সেও স্বাভাবিক। তবে কতটুকু উৎরে গেলেন সেটা পাঠক ভালো বলতে পারবেন। প্রথম কাজটা পড়ার। কিন্তু কেন পড়বেন?
সুবর্ণ আদিত্য প্রেমের কবিতা লেখেন। টানছে না?
সুবর্ণ আদিত্য দ্রোহের কবিতা লেখেন। টানছে না?
সুবর্ণ আদিত্য বোধের দেয়ালে ধাক্কা দিতে জানেন। ধাক্কা কি লাগলো?
কেমন হয় যদি সবগুলোই একেবারে পেয়ে যান?
ফারদুন ডেনমার্কে, শীতের দেশ। কবি বলছেন,
“ভরা ডিসেম্বরেও এখানে শীত নেই— সবটাই নিয়ে গেছ?”
এই হাহাকার কেবলই প্রেমের?
বলছেন,
“ট্রেনে চেপে দুইশ মাইল পথ
নির্বিঘ্নে কুড়ি মিনিটে চলে যেতে পার
আমি সাধারণ বাঙালি— আফসোস করি
দূর থেকে বুঝি— আরো কতটা গতিময় হয়েছ তুমি”
এই ধাক্কাটা আমি ভালোবাসি। পাঠককে ধাক্কা দিয়ে দূরত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেন বলতে পারা— নেই বলেই সমস্তে আছি আমি।
“নীলক্ষেতের পথে একবার বলেছিলেঃ যানজট থাকলে, যানবাহন
কিংবা যাত্রী কারো জন্যই তোমার কষ্ট হয় না
দুঃখ হয় রাস্তাটার জন্য— কতটা ভার বয়ে রাখে সে”
বলেছিলাম সব একসাথে পাবার কথা, আরও ভিন্ন কিছু চোখ আরও কিছু পথ পাবে। সে পথের সৌন্দর্য্যও আলাদা হবে কিন্তু সবই কবিতা। শুদ্ধতম স্বর।
“ফারদুন গণিতে কাঁচা
একটা টিউটর নিয়োগ দিলে পাখিদের ভাষা বুঝে নিতে পারত”
কিছু দৃশ্য, কিছু কথা, সেটাকে ভিজ্যুয়াল করে চোখের সামনে আছড়ে ফেলা।
“নদীটা গণিতে খাটো
গাছটা ছায়া বাঁকা
একদিন
হঠাৎ...
ফারদুন চমৎকার উড়ে গেল”
মুগ্ধতার সংজ্ঞা এইখানে পাওয়া গেল। পাওয়া গেল—
“খাবারের প্লেট থেকে গড়িয়ে যাবে
ছাপ্পান্ন হাজার মাইল দুর্ভিক্ষ”
“বনমন্ত্রী কী জানে, যশোর রোডের গাছগুলোও গাছ!”
কিংবা
“পুরো পৃথিবীর দুর্ভিক্ষটাকে চুরি করে নিয়ে যাবে— এমন চোর কোথায়?”
এবং
“ধর্ম জানে না, মাথা ছাড়া মানুষের আয়ু থাকে না”
পাঠকের ধর্মকে যদি হৃদয়ঙ্গম করা বলি, তবে আপনি আমন্ত্রিত সুবর্ণ আদিত্যে।
যিনি লিখেন,
“গোলাপের আয়ুর কাছাকাছি ছিল
আমাদের ঝরে পড়া”
মূলত সবকিছুই তাই, অপার মুগ্ধতা নিয়ে সমস্ত কিছু বিনাশ হবার অপেক্ষা করছে এক বোধের পৃথিবীতে।
না পাওয়াঃ
আগেই বলেছিলাম সিরিজ কবিতা লেখা দুঃসাহস। কবি আশাকরি ভালো প্রস্তুতি নিয়েই করেছেন। তথাপিও বেশ কিছু জায়গায় ফারদুন নামের বাহুল্যতা লক্ষণীয়। আরেকটু সতর্ক হলেই এগুলো কাটাতে পারতেন, সে সামর্থ্য কবির আছে।
কিছু পাঞ্চ লাইন তৈরি করতে চেয়েছেন। বেশিরভাগ জায়গাতেই সফল। কিন্তু ঐ যে তৈরি করতে চাওয়া এখানেই সমস্যা হয়েছে কয়েকটা জায়গায়। হয়তো তৈরি করার চেয়ে তৈরি হয়ে গেলে সেখানেই থেমে যাওয়াটা উচিত। একই কথা প্রযোজ্য আগের মতোই। যেহেতু বেশকিছু জায়গায় পেরেছেন চাইলে সবখানেই পারবেন।
কবিতার লাইনগুলোর কানেক্টিভিটিও কম। ইমেজারি, গল্প বলা সবমিলিয়েই কিছুটা ছাড়া ছাড়া ব্যাপার আছে।
ফারদুন সিরিজে তিনি পাঠককে দুর্বোধ্যতা, পরাবাস্তবতার ফাঁদে একেবারে আটকে ফেলেননি, ছেড়েও দেন নি। বরং যথেষ্ট জায়গা দিয়েছেন প্রত্যেকের মগজের মনন যাচাই করে নেবার। এটা সমালোচনা নয় তবে পাঠককে টেনে ধরে রাখবার যে ক্ষমতাকে আমি শ্রদ্ধা করি সেটা পরাবাস্তবতা আর বাস্তবতার সম্মিলন ঘটাতে উনার যে সতেচন প্রচেষ্টা ছিল সেটাই কিছু ক্ষেত্রে শেষ করার আনন্দটুকু পেতে দেয়নি।
পুনশ্চঃ আমি বলবো সব মিলিয়ে এই বইটা টাকা দিয়ে কিনে টাকাটা জলে ভাসানো হবে না, যে ভালোবাসে, বাসতে চায়, বাসাতে চায় সে পায়ের ধুলোকেও প্রেমের ইশারা করে তুলতে জানে এইটুকু বলা ভালো।
কবি লিখেছেন,
“জাদু দেখাবার পর তিনিও মানুষের মতো হেঁটে গেলেন...”
এই লাইনটাতে কবি সুবর্ণ আদিত্য থাকুন, পাখির আর পাঠকের চোখে। হ্যাপি জার্নি।
নোট: বইটি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ঢাকা ৫৭৩ ও চট্টগ্রামে ৮১+১০১ নাম্বার পেন্সিলের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। দাম ১শ টাকা।
এসি