ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে’

ইমদাদ হক

প্রকাশিত : ১১:০০ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ১১:০০ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শনিবার

মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন, বিএসপি, এসজিপি, এনডিসি, এইচডিএমসি, পিএসসি, পিএইচডি। তিনি বর্তমানে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে কর্মরত। ‘১৯৭১: প্রতিরোধ সংগ্রাম বিজয়’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ রূপ। বইটি প্রথমে ইংরেজিতে ‘1971: Resistance, Resilience and Redemption’ বের হয় বছর খানেক আগে। পরে বইটির বাংলা সংস্করণ বের করা হয়।

বাংলাদেশের ভৌগলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। রয়েছে প্রতিটি অধ্যায়ে লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ ও মন্তব্য। যা বইটিকে করেছে স্বাতন্ত্রমন্ডিত। সেই হিসাবে বইটির রচয়িতা ও বিশ্লেষকারী একজন অগ্রণী ইতিহাসকার ও গবেষক।

গত ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবভনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। সে সময় তিনি বিচক্ষণ লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার আহ্বান জানান। বলেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের প্রত্যেকে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে। তিনি বলেন, আমি আশা করবো, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাবেন। যা দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানাতে সহায়ক হবে।

এর পর আলোচনায় আসে বইটি। যদিও বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ নিয়ে আলোচনা চলছে এক বছর ধরেই। এই প্রকাশনার পর এক দুপুরে লেখকের অফিসে হাজির হই। কথা হয় বইটি রচনার প্রেক্ষাপট, দীর্ঘকালের গবেষণা, হারিয়ে যাওয়া তথ্য, দলিল-দস্তাবেজ পুনুরুদ্ধার আর বিশ্লেষণের অজানা কথা নিয়ে।

মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন জানান, তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম সাত বছরের বালক। আবার, সেই সময়ে আমার পিতা পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। আমরা বাবার কর্মস্থল করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাঁটিতে বাস করতাম। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক উত্তেজনা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তার তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। মার্চের শেষে কোন একদিন মায়ের সঙ্গে নাস্তা করছিলাম। নাস্তা খেতে খেতে মা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় দুই বিশালদেহী পাঞ্জাবি সৈন্যবেষ্টিত সোফায় বসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখিয়ে উনার গ্রেফতারের কথা বলছিলেন। সেটিই ছিল একাত্তরের স্মরণীয় স্মৃতি। আরও পরে একাত্তরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় বিমানবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ শুরু করলে যুদ্ধের ভয়াবহতা টের পাই। এরপর নিরাপত্তা পরীখা খনন করে আপাত জীবন রক্ষা। পরে দেশ স্বাধীন হলেও পাকিস্তানের মৌরিপুরের সামরিক ঘাটির কুলি ক্যাম্পে এক বছরেরও বেশি সময় আমাদের বন্দী থাকতে হয়েছে। ১৯৭৩ সালের মার্চের এক রাতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির ভাড়া করা এক বিমানে করে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। কাজেই সে সময়ের ঘটনা প্রবাহ আমার মনে বিশেষ দাগ কাটে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ আরও প্রবল হয়।

ধোঁয়া ওঠা কফির সঙ্গে চলতে থাকে আলাপ। শাহীন স্কুল, কুর্মিটোলা ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষা শেষে তিনি ডিসেম্বর ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। পেছনের দিনগুলোর কথা উঠে আসছিল সহজ ভাষায়, গল্পোচ্ছলে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকি। জানতে পারি তার কর্মজীবন আর গবেষণা শুরুর প্রেক্ষাপট।

তিনি বলেন, স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করি। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট জানার আগ্রহ সত্বেও সময় ও সুযোগের অভাবে তা হয়ে উঠছিল না। অবশেষে ১৯৯৯ সালে মেজর পদবীর অফিসার হিসেবে ঢাকা সেনানিবাসে নির্মিতব্য বিজয়কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। তখন বিভিন্ন বই-পুস্তক, দলিল দস্তাবেজ পড়া শুরু করি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর মনে হলো আমাদের যুদ্ধ নিয়ে প্রকাশনার সংখ্যা অনেক হলেও মানসম্পন্ন প্রকাশনার চাহিদা রয়েছে। এমন ভাবনা থেকেই কাজ শুরু।

দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষিত মেজর জেনারেল সরোয়ার সফলতার সঙ্গে বিভিন্ন আভিযানিক, স্টাফ ও শিক্ষামূলক দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ পেশাগত জীবনে তিনি দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজ করার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিযানসহ সন্ত্রাস দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪ ইস্ট বেঙ্গল ও ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেডের নেতৃত্ব প্রদান এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় শান্তি রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনের নানা পর্যায়ের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বইটির রচনা সহজ হয়ে উঠে। তাই তো বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র ও নকশা উপস্থাপন করা হয়েছে।

আমাদের ইতিহাসের অনেকগুলোই একপেশে, অপূর্ণাঙ্গ ও ধারণাভিত্তিক তথ্য নিয়ে। এদিক থেকে ব্যতিক্রম এই বইটি। মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন ভারতের হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার উচ্চশিক্ষার বিষয়ও ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বলছিলেন, যুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ততার ফলে, এ বিষয়ে কাজ করতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এক ধরনের আবেগ কাজ করে, যা খুবই সংগত ও স্বাভাবিক। বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণেই আমার যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। তবে, প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় আমার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করাটা বেশ সহজ হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমার ভেতরে কোন ব্যক্তি, অঞ্চল বা ঘটনাকে বড় করে দেখার মানসিকতা কাজ করেনি। ঐতিহাসিক সত্যগুলো নির্মোহভাবে উপস্থাপনে মনোনিবেশ ছিল সব সময়।

পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখকের মন্তব্য, এই বইটি পড়লে মুক্তিযুদ্ধকে সহজভাবে বোঝা যাবে। এখানে সম্পূর্ণ যুদ্ধের একটা সামগ্রিক চিত্র নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে রেখে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ফোর্সেস এর গঠন, অনিয়মিত বাহিনীসহ মুক্তিযুদ্ধাদের অবদান সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যা পড়ে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম গর্ববোধ করতে পারবে।

মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার হোসেন শান্তি ও যুদ্ধকালীন সময়ে দায়িত্ব পালনের জন্য সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। দীর্ঘ সময়ের কাজের অভিজ্ঞতাও উঠে আসে লেখকের কণ্ঠে। তিনি বলেন, আসলে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপনের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত অনেক প্রকাশনা কলেবরে সীমিত বা কখনো নির্দিষ্ট অঞ্চল ও ঘটনাভিত্তিক হওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। আমার বইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকার ব্যাপারে একটা স্বচ্ছ ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কাজের ক্ষেত্রটি মূলত ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। আসলে এই সময়টিতে কোন বিতর্ক আগেও ছিল না, আর এখনও আছে বলে মনে হয় না। আছে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ ও তার পাশাপাশি অনেকের কাপুরুষোচিত ভূমিকা। এর সবগুলোই ঐতিহাসিক ঘটনা, ভালো-মন্দ মিলিয়ে দুটোই স্থান পেয়েছে এই বইয়ে, অন্যথায় একটি ছাড়া অপরটির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হতো না।

মেজর জেনারেল মো. সরোয়ার সমসাময়িক বিষয়ের ওপরে বিভিন্ন জার্নাল ও পত্রিকায় লিখে থাকেন। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক লেখার সংকলন Random Thoughts তাঁর প্রথম গ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধসহ যেকোনো উন্নয়ন ও গবেষনামূলক কাজের সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে ভালোবাসেন। নতুন প্রজন্মের পাঠকদের ব্যাপারে লেখকের পরামর্শ, নতুন প্রজন্মের সবাই যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে এবং জানার চেষ্টা করে। আমি কোথায় থেকে এসেছি, তা না জানলে আমি কোথায় যাব, সে ব্যাপারে কখনোই স্বচ্ছ ধারনা তৈরি হবে না। তাই ইতিহাস জানা জরুরি।

লেখক: বিজনেস রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।