ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

২০০ দেশে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরবো: নাজমুন নাহার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:১৮ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৮:৫১ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সোমবার

নাজমুন নাহার

নাজমুন নাহার

নাজমুন নাহার সুপরিচিত একটি নাম। বিশেষ করে ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে। সারা বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি একের পর এক দেশ ভ্রমণ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বে। তিনি বিশ্বাস করেন- ‘স্বপ্ন দেখলে আর তার জন্য কাজ করলে পৃথিবীতে সবই সম্ভব’।

ইতোমধ্যে তিনি ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর বাকি দেশগুলোও ভ্রমণের স্বপ্ন দেখছেন তিনি। ২০২১ সালের মধ্যে ২০০ দেশ ভ্রমণ করে গিনিজ বুকে নাম উঠাতে চান। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নারী হিসেবে ২০০ দেশ ভ্রমণের রেকর্ড গড়তে চান। সেই সঙ্গে তিনি বিশ্বের কল্যানে কাজ করতে চান। সারা বিশ্বের শিশুদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার। সম্প্রতি তিনি এই ১২৫ দেশ ভ্রমণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন একুশে টেলিভশন অনলাইনের অফিসে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা মাসুদ রানা

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে এই ভ্রমণের পেছনে কে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?

নাজমুন নাহার: আমি যখন ছোট ছিলাম তখন পাখির আকাশে উড়া দেখে আমিও স্বপ্ন দেখতাম আকাশে উড়ার। তখন বাবাকে এই কথা বললে তিনি আমার সাহস দিয়েছেন। তাছাড়া বিদেশ ভ্রমণে আমার বাবা ও দাদা আমাকে সার্বক্ষণিক উৎসাহিত করেছেন। আমার দাদা উনিশ শতকের শুরুর দিকে আরব দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাবাও বহু দেশ সফর করেছেন। এই দুজনকে দেখে আমি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তবে বাবার উৎসাহ ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমি থেমে নেই, লাল সবুজের পতাকা হাতে দুর্বার গতিতে বিশ্ব জয় করতে এগিয়ে চলছি। বুকে আমার বাংলাদেশ। হাতে লাল সবুজের পতাকা। বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছি বাংলাদেশের কথা, মানবতার কথা, বিশ্ব শান্তির কথা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি কবে থেকে এই স্বপ্ন পূরণের যাত্রা শুরু করলেন?
নাজমুন নাহার: আমার এই স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ ছিল ভারত। তখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম। ২০০০ সালে ভারতের ইন্টারন্যাশনাল এডভেঞ্চার প্রোগ্রামের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে আমার প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়। তখন আমি ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে যাই। এটাই আমার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। বিশ্বের ৮০টি দেশের ছেলেমেয়ের সামনে তখন আমি প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে আমার বিশ্ব যাত্রার শুরু।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি বিশ্বের যে দেশগুলোতে ভ্রমণ করছেন। সেগুলো কোন মাধ্যমে বেশি?

নাজমুন নাহার: আসলে আমি বেশির ভাগ দেশ ভ্রমণ করেছি সড়কপথে। অনেক সময় দীর্ঘ পথ বাসে কাটাতে হয়েছে। নিজে গাড়ি চালিয়ে গেছি। কষ্ট হলেও যাত্রাটা আমি উপভোগ করেছি। এমনও অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি যে মোটরবাইকে চড়ে অনেক দীর্ঘ সময় যেতে হয়েছে। এছাড়াও কোনো দেশের একেবারে গ্রামের পথে যেতে পায়ে হেঁটেও গেয়েছি। অনেক পাহাড়ি এলাকা পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি কবে? কোন দেশে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে একশতম দেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন?

নাজমুন নাহার: আমি ২০১৮ সালের ১ জুন পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে গিয়ে একশতম দেশ ভ্রমণের মাইলফলক স্পর্শ করি। আমি বাংলাদেশের পতাকা হাতে জাম্বিয়ার সীমন্তবর্তী লিভিংস্টোন শহরে অবস্থিত পৃথিবীর বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ব্রিজের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে জিম্বাবুয়েতে পৌঁছাই। ইতিহাসে আমার শততম দেশ ভ্রমণের সাক্ষী হয়ে রইলো এই ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি ইতোমধ্যে ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। তবে শততম দেশ ভ্রমণের সেই অনুভূতিটি কেমন ছিল?

নাজমুন নাহার: সেই দিনের অনুভূতি সত্যি অসাধারণ ছিল। সেই দিন বাংলাদেশের পতাকা হাতে আমি যেন একা হাঁটেনি সেই দিন হেঁটেছিলাম বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ আমার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো সমস্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। সেই দিন শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেছি আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেছি যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন পতাকা তলে বেড়ে উঠেছি সেই সব যোদ্ধাদের। আর তাদের জন্যই আমরা পেয়েছি একটি লাল সবুজের পতাকা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি বিশ্বের বুকে পতাকা তুলে ধরার পাশাপাশি আর কি ধরনের কাজ করছেন?

নাজমুন নাহার: আমি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনে আমার মোটিভেশনাল স্পিসের মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। নিজের দেশের তরুণ সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করছি। এছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমি বিশ্বেও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশ্ব শান্তির বার্তা পৌঁছে দেই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভ্রমণের সময় আপনি কোন বাধা বা বিপদসংকুল অবস্থায় পড়েছিলেন কি না?
নাজমুন নাহার: হ্যাঁ, হয়েছি। বাংলাদেশের পতাকা হাতে এই দুর্বার দেশ জয় কতটা কঠিন ও বিপদসংকুল অভিযাত্রা ছিলো তা বলে বুঝানো যাবে না। তবে আমি মনে করি, পৃথিবীতে যা কঠিন তা সুন্দর। পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণের সময়ও আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। মৃত্যুকে জয় করে আজ আমার বেঁচে থাকা এই মৃত্যুঞ্জয়ী আমি বাকি সব দেশ ভ্রমণের স্বপ্ন দেখছি এখনও। দুরহ পথ সাধ্য করেছি। বাংলাদেশের লাল সবুজের এই পতাকা আমার কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি। এই পতাকা আমাকে ছায়া দিয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা হাতে যখনই আমি নতুন কোনো দেশের সীমান্তে পা দিয়েছি তখনই আমার সঙ্গে যেন জেগে উঠেছে ষোলো কোটি প্রাণ।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একজন নারী এবং বিশেষ করে বাংলাদেশি নারী হিসেবে এই ভ্রমণের সময় আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা?
নাজমুন নাহার: আমি মনে করি, প্রথমত এটি মানসিক সংগ্রাম। এ সংগ্রামে জয়ী হতে পারলে যে কোনো জিনিসই সহজ হয়ে যায়। পৃথিবীর যেখানেই যাই সেখানে আমি বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা সঙ্গে করে নিয়ে যাই। লাল-সবুজ এই পতাকা বিভিন্ন দেশের স্থানীয় লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফলে আমার জন্য সব কিছু সহজ হয়ে যায়।

 একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বাংলাদেশের পতাকা কেন সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন?
নাজমুন নাহার: পতাকা আমার কাছে দেশপ্রেমের একটি চিহ্ন, আবেগ ও ভালোবাসা। এই পতাকার মাঝে লুকিয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসা। আছে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো বহু শহীদের রক্ত। তাদের কারণে আমরা এ পতাকা পেয়েছি। আমরা তো নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশের জন্য কিছু করতে পারি। আমি ভ্রমণ করছি, পৃথিবী দেখছি। কিন্তু আমার দেশ আমার সঙ্গে যাচ্ছে এ পতাকার মাধ্যমে। আমি পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছি শান্তির বার্তা। আমরা একই পরিবারের মানুষ, একই পৃথিবীর মানুষ, ধর্ম-বর্ণ, জাতি আমি যে-ই হই না কেন শেষ পর্যন্ত আমরা তো সবাই একই আকাশের নিচে বসবাস করছি ।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ১৮ বছর ধরে আপনি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু এ জন্য তো সময় এবং অর্থ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এসব আপনি কীভাবে ব্যবস্থা করলেন?

নাজমুন নাহার: আমি বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে প্রথম কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছি। পরে আমি বৃত্তি নিয়ে সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। সেখানে পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখতে থাকি আরও দেশ ভ্রমণের । সেই সময় আমি বিশ্ব ভ্রমণের লক্ষ্যে অর্থ সঞ্চয়ের জন্য প্রচুর কাজও করতাম। ‘আমি জানতাম কষ্ট করে উপার্জন না করতে পারলে আমি ভ্রমণ করতে পারবো না। তাই গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কোন কোন দিন আছে, আমি ১৭-১৮ ঘণ্টা ধরেও কাজ করেছি। আর সেই উপার্জিত অর্থ দিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করছি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: টার্গেট পূরনের পর আপনার কি পরিকল্পনা আছে?
নাজমুন নাহার: ‘ইনসপিরেশন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’ নামের একটি উদ্যোগ শুরু করেছি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলের শিশু ও তরুণদের স্বপ্ন দেখানো। আর তাদের কাছে নিজের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা বর্ণনা করব।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এই দেশগুলো ভ্রমণ করতে গিয়ে ভিসা সমস্যায় পড়েছেন?

নাজমুন নাহার: আমি তেমন সমস্যায় পড়ি নাই। কারণ হিসেবে বলা যায়, আমি যেহেতু আমেরিকা,  বৃটেন, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ ভ্রমণ করেছি। তাই অন্য দেশে যেতে চাইলেই তারা আমাকে ভিসা দিয়েছে। তেমন কোনো সমস্যায় পড়ি নাই। তবে, একে বারেই যে সমস্যা হয়নি তা নয়, সেটা খুব বেশি না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বিদেশ ভ্রমণের সময় রাষ্ট্রদূতদের সহায়তা পেয়েছেন কি না?
নাজমুন নাহার: বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রয়েছে তাদের কাছে তেমন যাই নাই। আর আমি তেমন কোনো সমস্যায় পড়ি নাই এ জন্য আসলে তাদের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে নাই। তবে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা বেশ হেলফুল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এই দেশগুলো ভ্রমণের জন্য কোনো স্পন্সর পেয়েছেন কি?
নাজমুন নাহার: আমি স্পন্সর পাই নাই। আমার কষ্টের জমানো টাকা দিয়েই দেশ ভ্রমণ করে যাচ্ছি। এ জন্য আমাকে খুব কষ্ট করে দেশ ভ্রমণ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় কোনো গ্রামের ভেতর কারো গেস্ট হয়ে থাকতে হয়েছে। এমনও হয়েছে খোলা যায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে। তবে, ইচ্ছে শক্তি থাকায় আমি একটির পর একটি দেশ ভ্রমণ করে যাচ্ছি। আমার লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পরিবারের কাউকে নিয়ে দেশ ভ্রমণ করেছেন?
নাজমুন নাহার: হ্যাঁ, আমি আমার মাকে নিয়ে বিশ্বের প্রায় ১৪টি দেশ ভ্রমণ করেছি। সেটা অন্যরকম এক ভালো লাগা। সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।


নাজমুন নাহার ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার গঙ্গাপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই নাজমুন নাহার মেধাবী এবং বিনয়ী হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। নন্দনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর কৃতিত্বের সঙ্গে জেলা বৃত্তি নিয়ে উত্তীর্ণ হন। দালাল বাজার নবীন কিশোর (এনকে) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এসএসসি এবং লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য সুইডেনে যান। সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন!

ব্যবসায়ী পিতা মোহাম্মদ আমিন ২০১০ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মা তাহেরা আমিন। নাজমুন নাহার তিন ভাই এবং পাঁচ বোনের মধ্যে সবার ছোট।

এসএইচ/